লোকসভার স্পিকারের নিরপেক্ষতা সম্পর্কে আলােচনা করাে।

ভূমিকা: ভারতের সংসদীয় শাসনব্যবস্থার জনপ্রিয় কক্ষ জনপ্রতিনিধিসভা বা লােকসভার সভাপতি হলেন মাননীয় স্পিকার। লোকসভার কার্যাবলি পরিচালনা, সভার মর্যাদা ও ক্ষমতা রক্ষার ক্ষেত্রে স্পিকারের ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আইনসভার পরিচালক হিসেবে স্পিকারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্পিকার হলেন আইনসভার মর্যাদার রক্ষক। সর্বভারতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত লোকসভা যেহেতু সমগ্র জাতির প্রতিনিধিত্ব করে, সেহেতু স্পিকার পদের গুরুত্ব জাতীয় মর্যাদাভুক্ত। এই কারণে স্পিকারের কাজ হল দলীয় স্বার্থের উর্ধ্বে উঠে দলমত নির্বিশেষে সকলের জন্য নিরপেক্ষভাবে লোকসভার কাজ পরিচালনা করা। ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি বলেছিলেন, দলনিরপেক্ষতা হল আইনসভার সভাপতির আবশ্যিক যােগ্যতা। স্পিকারের ব্যক্তিগত যােগ্যতা, দক্ষতা, রাজনৈতিক জ্ঞানের পরিপক্বতা, অভিজ্ঞতা এবং নিরপেক্ষতা ইত্যাদির উপর সংসদীয় গণতন্ত্রের সাফল্য অনেকাংশে নির্ভর করে।


স্পিকার পদের নির্বাচন: নবগঠিত লোকসভার প্রথম অধিবেশনেই সভার সদস্যগণ নিজেদের মধ্য থেকে একজন অধ্যক্ষ (স্পিকার ৯৩ নং ধারা) এবং একজন উপাধ্যক্ষ (ডেপুটি স্পিকার) নির্বাচিত করেন। লোকসভা সম্পূর্ণ মেয়াদ অবধি তিনি সেই পদে অধিষ্ঠিত থাকেন। ভারতের স্পিকার কে ইংল্যান্ডের স্পিকারের প্রতিলিপি বলা যায়।


লোকসভার স্পিকারের নিরপেক্ষতা

ইংল্যান্ডের আইনসভার নিম্নকক্ষ কমন্স সভার অধ্যক্ষের অনুকরণে ভারতের লোকসভার অধ্যক্ষের দলনিরপেক্ষ চরিত্রের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরােপ করা হয়েছে। অধ্যক্ষ বা স্পিকার দলীয় নির্দেশ বা রাজনীতির উর্ধ্বে থেকে নিরপেক্ষভাবে যাতে তার কার্যাদি সম্পাদন করতে পারেন তার জন্য সংবিধানে কয়েকটি বিশেষ বিধিবিধানের ব্যবস্থা করা হয়েছে一


(1) স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের বেতন, ভাতা ইত্যাদি যে খাতে ব্যয় হয়, তা রাজ্যের সঞ্চিত তহবিল থেকে প্রদান করা হয়। এই ব্যয়ের জন্য প্রতি বছর লোকসভা অনুমােদনের প্রয়ােজন হয় না।


(2) স্পিকারকে সহজে অপসারণ করা যায় না বলেই বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করতে হয়। স্পিকারের বিরুদ্ধে অভিযােগ বা অনাস্থা প্রস্তাব আনতে হলে অন্তত ১৪ দিন পূর্বে নোটিশ দিতে হয়।


(3) লোকসভা নিম্নকক্ষের সভাপতি স্পিকারের সাধারণত লোকসভার কোনাে তর্কবিতর্কে বা সমালােচনায় অংশগ্রহণ করতে পারেন না।


(4) সাধারণভাবে কোনাে বিলের উপর ভ্যাট দেওয়ার অধিকার স্পিকারের নেই। তা ছাড়া যদি কোনাে প্রস্তাবের পক্ষে এবং বিপক্ষে সমানসংখ্যক ভোট পড়ে এবং সেইসময় যদি অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়, তাহলে অধ্যক্ষ একটি নির্ণায়ক ভােট (Casting Vote) প্রদান করে সেই অচলাবস্থা দূরীকরণের চেষ্টা করবেন। তবে অধ্যক্ষের অপসারণ সংক্রান্ত কোনো প্রস্তাবের ক্ষেত্রে তিনি নির্ণায়ক ভােট প্রদান করতে পারেন না।


(5) স্পিকারের আচরণ ও কাজকর্মকে আদালতের এক্তিয়ার-বহির্ভূত রাখার জন্য আদালতে কোন প্রকার জবাবদিহি করতে হয় না।


(6) লোকসভার স্পিকার দলনিরপেক্ষতা বজায় রাখার জন্য নিজ দলের সঙ্গে কোনােরকম সংযােগ-সম্পর্ক বজায় রাখে না। যদিও এই ব্যবস্থা ভারতের চেয়ে ইংল্যান্ডে অনেক বেশি সাফল্যলাভ করেছে। ভারতে সাফল্য লাভ করতে পারেনি কারণ, ভারতে পরবর্তী নির্বাচনে জয়লাভের জন্য স্পিকার নিজ দলের সঙ্গে এবং দলীয় স্বার্থের প্রতি সবসময় নজর রেখে চলেন। এই বিষয়টিকে সাংবিধানিক রীতিনীতির পরিপন্থী বলে অনেকে মনে করেন।


(7) সংবিধান প্রণেতারা মনে করেন, স্পিকার দলীয় রাজনীতির উর্ধ্বে গিয়ে সভা পরিচালনা করেন। এই কারণেই স্পিকার নিজেই নিরপেক্ষ থেকে বিরােধী রাজনৈতিক দলকে কার্যকরী গঠনমূলক ভূমিকা পালনের সুযােগ করে দেন। সুতরাং স্পিকারের দক্ষতার উপর বিরােধীদলের আশা অনেকটাই নির্ভর করে। লোকসভার প্রথম স্পিকার জি ভি মভলংকার স্পিকারের ভূমিকা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, স্পিকার তার পদের মর্যাদা ও নিরপেক্ষতা ক্ষুন্ন যাতে না হয় তারজন্য তিনি কোনাে কাজের সঙ্গে নিজেকে জড়িত রাখবেন না।


লোকসভার অধ্যক্ষের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের পরিপ্রেক্ষিতে স্পিকারকে লোকসভার অভিভাবক বলে অভিহিত করা যায়। স্পিকার সংসদীয় গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করে থাকেন। তবে ভারতের স্পিকারের ক্ষেত্রে দলনিরপেক্ষতার কোনাে সুস্থ ঐতিহ্য গড়ে ওঠেনি। কারণ এখানে বিভিন্ন সময়ে দলীয় রাজনীতির জোরে দলীয় নেতারাই স্পিকার পদে আসীন হয়েছেন। এর ফলে বিভিন্ন কার্যধারার মধ্যে তাদের দলীয় মনােভাব ও পক্ষপাতিত্ব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যেমন ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দের ১৭ মার্চ সঞ্জীব রেড্ডি স্পিকার হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর দলনিরপেক্ষতার আদর্শ প্রতিষ্ঠার কারণে তিনি কংগ্রেস দলের সদস্যপদ ত্যাগ করেন। কিন্তু এই নিরপেক্ষতা তিনি বেশি দিন বজায় রাখতে পারেননি এই কারণেই ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে শ্রী সঞ্জীব রেড্ডি কংগ্রেস দলের প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামেন। অপরদিকে এইরকমও দৃষ্টান্ত আছে যেখানে লোকসভার স্পিকার তার নিরপেক্ষতার নীতি বজায় রেখেছেন। যেমন— বিগত চতুর্দশ লোকসভায় (২০০৪-২০০৯ খ্রি.) স্পিকার সােমনাথ চট্টোপাধ্যায় (ভারত-মার্কিন চুক্তির প্রশ্নে) কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউ পি এ সরকারের বিরুদ্ধে বামপন্থী-সহ বিরােধীদলের অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপনের সময় ভােটাভুটির প্রশ্নে নিরপেক্ষতার নীতি গ্রহণ করেছিলেন। এই কারণে তাঁকে সিপিআই (এম) দল থেকে বহিষ্কার করা হলেও তিনি তার সিদ্ধান্তে কিন্তু অনড়ই ছিলেন। এ প্রসঙ্গে কেভি রাও বলেছেন, স্পিকারের কিছু সিদ্ধান্ত বিরােধীদের কাছে ক্ষমতাসীন দলের স্বার্থরক্ষার অভিসন্ধি হিসেবে সন্দেহ প্রকাশ করছে ("Some of the rulings of speakers are not beyond reasonable suspicion of the opposition that the office is being used to protect the interests of the party in power.")


মূল্যায়ন: পরিশেষে বলা যায় যে, অধ্যক্ষ নির্বাচনের সময় বর্তমান ব্যবস্থার পরিবর্তে সকল দলের সঙ্গে আলােচনা সাপেক্ষে লোকসভার অভিজ্ঞ ও প্রবীণ কোনাে নির্বাচিত ব্যক্তিকে স্পিকার পদে মনােনীত করা উচিত। এ ছাড়া সরকার পক্ষ যদি অধ্যক্ষের পদে নিজেদের প্রার্থী মনােনীত করে তাহলে উপাধ্যক্ষ পদে বিরোধী দলের সদস্যকে মনােনীত করলে সুস্থ গণতান্ত্রিক পরিবেশ প্রতিষ্ঠা অনেক সহজতর হবে। অনেকে মনে করেন যে, অধ্যক্ষ পদের মর্যাদারক্ষার জন্য স্পিকার পদ ত্যাগের পর কোনাে মন্ত্রীত্ব বা রাজ্যপালের পদ কিংবা রাষ্ট্রপতি পদ গ্রহণ করা উচিত নয়। কারণ স্পিকার পদ জাতীয় সম্মানজনক এবং স্বাধীন পদ বলে বিবেচিত হয়েছে। বর্তমানে ১৬ তম লোকসভা নির্বাচনে সুমিত্রা মহাজন স্পিকার পদে অধিষ্ঠিত হয়ে নিরপেক্ষভাবে সেই পদটির দায়িত্ব পালন করছেন। জোহারি এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন, স্পিকারের ভূমিকা প্রসঙ্গে জোহারির মন্তব্য হল যে, আমরা আজও পর্যন্ত প্রকৃতভাবে দল নিরপেক্ষ স্পিকার তৈরি করতে সক্ষম হইনি (".. .we have remained far from being able to develop the sound tradition of his, speaker's being a Non Party man.")।


ভারতীয় সংসদে বিরােধীদলের ভূমিকা আলােচনা করাে।


ভারতের সংসদে আইন পাসের পদ্ধতি | ভারতীয় পার্লামেন্টের আইন পাসের পদ্ধতি


লােকসভায় অর্থ বিল পাসের পদ্ধতি | ভারতীয় সংসদে অর্থবিল পাসের পদ্ধতি


ভারতের পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব | ভারতের পার্লামেন্ট কি প্রকৃতই সার্বভৌম | ভারতের পার্লামেন্টের কতদূর পর্যন্ত আইন প্রণয়নকারী সংস্থা হিসেবে গণ্য করা যায়?


ভারতীয় পার্লামেন্টের ক্ষমতা হ্রাসের মূল কারণগুলি কী কী?


রাজ্যসভার গঠন, ক্ষমতা ও কার্যাবলি | রাজ্যসভার গঠন আলােচনা করো।


যেসব বিষয়ে রাজ্যসভা লােকসভা অপেক্ষা অধিক ক্ষমতার অধিকারী সেই বিষয়গুলি আলােচনা করাে।


লোকসভার গঠন, ক্ষমতা ও কার্যাবলি আলােচনা করাে।


লোকসভা কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে রাজ্যসভা অপেক্ষা বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন?


রাজ্যসভা ও লোকসভার সম্পর্কের মূল বৈশিষ্ট্য | ভারতীয় সংসদের দুটি কক্ষের সম্পর্ক | রাজ্যসভা ও লোকসভার সাংবিধানিক সম্পর্ক


ভারতের কেন্দ্রীয় আইনসভার ক-টি কক্ষ রয়েছে? রাজ্যসভা ও লোকসভার ক্ষমতার তুলনা


লোকসভার স্পিকারের ক্ষমতা | লোকসভার অধ্যক্ষের ক্ষমতা, কার্যাবলি ও পদমর্যাদা | লোকসভার স্পিকারের ভূমিকা