রাষ্ট্র প্রসঙ্গে গান্ধীজীর ধারণা ব্যাখ্যা করাে।

রাষ্ট্র প্রসঙ্গে গান্ধীর ধারণা

গান্ধীজীর রাষ্ট্র সম্পর্কে চিন্তাভাবনার প্রথম প্রকাশ ঘটে তাঁর 'হিন্দু স্বরাজ নামক গ্রন্থে। এ ছাড়াও হরিজন’, ইয়ং ইন্ডিয়া’ প্রভৃতি পত্রপত্রিকায় তাঁর রাজনৈতিক ধ্যান ধারণার প্রকাশ ঘটে। গান্ধীজীর রাষ্ট্র সম্পর্কিত চিন্তা দর্শন সংক্ষেপে নিম্নে আলােচিত হলㅡ


(১) ব্যক্তিত্বের বিকাশ: গান্ধীজীর রাষ্ট্রচিন্তার মূল কথা হল- মানুষের ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশ ঘটানাে। তিনি বলেছেন, মূল যদি সুমিষ্ট হয় ফল মিষ্টি হতে বাধ্য। জনগণ হল মূল, রাষ্ট্র হল ফল ("if the roots are sweet, the fruits are bound to be Sweet")। মানুষ যদি ভালাে হয়, রাষ্ট্র তাহলে নিশ্চিতভাবে ভালাে হবে, মানুষ ভালাে হতে গেলে তার ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটাতে হবে, তার জন্য রাষ্ট্রের হাতে বেশি ক্ষমতা দিলে চলবে না। মানুষ নিজের ভালােমন্দ নিজে ভালাে বুঝতে পারে। তার জন্য রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের প্রয়ােজন নেই। রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করলে ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশ ব্যাহত হবে।


(২) রাষ্ট্র ক্ষতিকর প্রতিষ্ঠান: মার্কসের মতাে গান্ধিজি রাষ্ট্রের প্রকৃতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, এটি একটি ক্ষতিকর প্রতিষ্ঠান। গান্ধী মনে করেন, রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি হল হিংসা ও বলপ্রয়ােগ। তার ভাষায়, 'The State represents violence in a concentrated and organised form'। অর্থাৎ রাষ্ট্রসংঘটিত এবং পরিকল্পিতভাবে হিংসা প্রয়ােগ করে বলপ্রয়ােগের মাধ্যমে। গান্ধীজীর ভাষায়, সেই রাষ্ট্রই সর্বোৎকৃষ্ট যা সব থেকে কম শাসন করে ("That government is best which governs the least”)


(৩) রাষ্ট্রহীন ও দলহীন গণতন্ত্র: গান্ধিজি বলেছেন যে, রাষ্ট্র যেহেতু হিংসার প্রতীক এবং দল যেহেতু হিংসার পথ গ্রহণ করে, সেহেতু আদর্শ সমাজ ব্যবস্থা হল দল ও রাষ্ট্রহীন গণতন্ত্র। এই সমাজ ব্যবস্থায় প্রত্যেকেই শাসক, এই সমাজ ব্যবস্থা হল আদর্শ সমাজ ব্যবস্থা, যাকে গান্ধিজি বলেছেন রামরাজ্য বা শ্রেষ্ঠ শাসনব্যবস্থা। এই শ্রেষ্ঠ শাসন ব্যবস্থায় সকল মানুষের জন্য সমান সুযােগ থাকবে, সমাজ হবে শােষণমুক্ত। সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে সাম্য ও বিকেন্দ্রীকরণ সমানভাবে বজায় থাকবে।


(৪) ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ: গান্ধিজি মনে করেন সকলের কল্যাণের জন্য ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ দরকার। সমস্ত ক্ষমতা রাষ্ট্রের হাতে না রেখে বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে তা ভাগ করে দেওয়া দরকার। তিনি পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অন্যতম মাধ্যম বলে মনে করতেন। পঞ্চায়েতের মাধ্যমে প্রতিটি গ্রাম হয়ে উঠবে এক একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রজাতন্ত্র। গান্ধিজির ভাষায়, আমার কল্পনায় গ্রাম স্বরাজ হল একটি সম্পূর্ণ প্রজাতন্ত্র।


(৫) আন্তর্জাতিকতাবাদ: গান্ধীজীর রাষ্ট্রচিন্তায় আন্তর্জাতিকতাবাদের প্রকাশ ঘটেছে। তিনি চেয়েছিলেন বিশ্বের সমস্ত মানুষ এবং জাতির মধ্যে সম্প্রীতি গড়ে উঠুক। জাতীয়তাবাদ থাকবে তবে তা উগ্র হবে না, জাতীয়তাবাদকে তিনি আন্তর্জাতিকতাবাদের সঙ্গে সমন্বয় ঘটাতে চেয়েছিলেন। অর্থাৎ নিজে বাঁচো এবং অপরকে বাঁচতে দাও Live and let Live -গান্ধীর রাষ্ট্রচিন্তার এটাই হল মূল বৈশিষ্ট্য।


(৬) পাশ্চাত্যকেন্দ্রিক গণতন্ত্র: পাশ্চাত্য কেন্দ্রিক গণতন্ত্রের রূপটিকে গান্ধিজি মেনে নিতে পারেননি। গান্ধিজির মতে, গণতন্ত্র ও হিংসা এই দুটি ধারণা কখনােই একসঙ্গে চলতে পারে না। গান্ধিজি মনে করেন প্রতিনিধির সংখ্যা অধিকভাবে থাকলেই যে গণতান্ত্রিক কাজকর্ম সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হবে, তার কোনো যুক্তি নেই। কারণ আমাদের সতর্ক থাকতে হবে যে, আমরা কখনো সংখ্যাগরিষ্ঠের দাস হিসেবে এই রাষ্ট্রব্যবস্থায় বসবাস করব না। এর জন্যই গান্ধিজি গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামাের সমালােচনা করেছেন।


সমালোচনা: গান্ধিজির রাষ্ট্র সম্পর্কিত চিন্তাধারাও সমালােচনার উর্ধ্বে নয়। নিম্নে সমালোচনাগুলো আলোচনা করা হল―


(১) স্ববিরােধী চিন্তা: গান্ধীজীর রাষ্ট্র সম্পর্কিত চিন্তাভাবনাও স্ববিরােধী দোষে দুষ্ট। কারণ, তিনি একদিকে রাষ্ট্রহীন বা দলহীন গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন আবার অপরদিকে চেয়েছেন। রাষ্ট্রের হাতে যাতে কম শাসনক্ষমতার ভার দেওয়া হয়। সমালােচকদের দৃষ্টিতে এটা গান্ধীজীর স্ববিরােধী চিন্তাভাবনা ছাড়া আর কিছু নয়।


(২) অহিংসা নীতির সমালোচনা: গান্ধিজি তার আদর্শ সমাজ ব্যবস্থা তথা রাম রাজ্যে যে অহিংসার নীতি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন, সমালােচকদের দৃষ্টিতে তা নিছকই কাল্পনিক চিন্তা ভাবনা। বলাবাহুল্য, আধুনিক বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলিতে হিংসা ও ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ ছড়িয়ে পড়ায় কীভাবে রাষ্ট্রহীন গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে অহিংসার মাধ্যমে তার মােকাবিলা করা যাবে তার পথ গান্ধিজি দেখাতে সক্ষম হননি।


(৩) অবাস্তব তত্ত্ব: সমালােচকদের মতে, গান্ধিজি পরিকল্পিত রামরাজ্য বর্তমান বিশ্বের রাজনীতিতে নিছকই অবাস্তব। কারণ তার এই তত্ত্বে নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতা যথেষ্ট গুরুত্ব পাওয়ায় বাস্তব সমাজ পরিস্থিতি অবহেলিত হয়েছে। বলা যেতে পারে যে, এই সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় গান্ধিজি নিজেও যথেষ্ট সন্দিহান ছিলেন।


(৪) ব্যক্তির উপর বেশি আস্থা: গান্ধিজির রাষ্ট্রহীন গণতন্ত্র ছিল মূলত ব্যক্তিকেন্দ্রিক অর্থাৎ ব্যক্তির উপর প্রবল আস্থা বা বিশ্বাসই ছিল এই গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি যা বাস্তব রাজনীতিতে একেবারেই অবাস্তব। এই ধরনের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাঁর বক্তব্য ছিল যে, সমাজে প্রতিটি ব্যক্তি নিজেই নিজেকে শাসক হিসেবে নির্বাচিত করে নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী সমাজের সেবা করলে এক শোষণমুক্ত সমাজ গড়ে উঠবে। সমালোচকদের মতে, এই ধারণা পুরােপুরি কাল্পনিক কারণ, সমাজ সর্বদাই ব্যক্তির ঊর্ধ্বে আর ব্যক্তি সেই সমাজের অন্তর্ভুক্ত। তাই গান্ধিজি ব্যক্তির উপর সম্পূর্ণরূপে আস্থাশীল হয়ে বাস্তব সমাজব্যবস্থাকে অস্বীকার করেছিলেন।


উপসংহার: সমালােচিত হলেও গান্ধীজীর রাষ্ট্র সম্পর্কে চিন্তাভাবনাগুলাের গুরুত্বকে কখনােই অস্বীকার করা যায় না, কারণ গান্ধীজীর রাষ্ট্রচিন্তায় পঞ্চায়েতিরাজ ব্যবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে বিবেচিত হয়। পঞ্চায়েতের গুরুত্ব অপরিসীম গণতন্ত্রের বিকাশ, গ্রামীণ প্রশাসন প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি ক্ষেত্রে। এ ছাড়াও গান্ধিজির রাষ্ট্র সংক্রান্ত চিন্তাভাবনাগুলি সামাজিক ও রাজনৈতিক আদর্শ হিসেবে আজও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।


অহিংস সম্পর্কে গান্ধিজির ধারণা | গান্ধীবাদের মূল নীতি অহিংসার মূল্যায়ন | অহিংসার প্রকৃতি | গান্ধীজীর ধারণায় অহিংসার অর্থ


সত্যাগ্রহের প্রকৃতি ও বিভিন্ন রূপ সম্পর্কে গান্ধীর মত বিশ্লেষণ | গান্ধীর সত্যাগ্রহ আন্দোলন


সর্বোদয় প্রসঙ্গে গান্ধীজীর ধারণা ব্যাখ্যা করাে।