লােকসভায় অর্থ বিল পাসের পদ্ধতি | ভারতীয় সংসদে অর্থবিল পাসের পদ্ধতি

অর্থ বিলের সংজ্ঞা

ভারতীয় সংবিধানের ১১০নং ধারায় অর্থ বিলের সংজ্ঞা প্রসঙ্গে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সংবিধানে অর্থ বিলের সংজ্ঞা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, নিম্নলিখিত বিষয়গুলির মধ্যে যে-কোনাে একটি বা একাধিক বিষয়ের উল্লেখ থাকলে তাকে অর্থ বিল বলে চিহ্নিত করা যাবে। যেমন—


  • কর ধার্য করা, বিলােপ করা, পরিহার করা, পরিবর্তন ও নিয়ন্ত্রণ করা সংক্রান্ত বিষয়।


  • ভারত সরকার কর্তৃক ঋণ গ্রহণ সংক্রান্ত বিষয়। অর্থাৎ সরকার কর্তৃক গৃহীত বা গ্রহণীয় কোনাে আর্থিক দায়িত্ব সম্পর্কে আইনের সংশােধন।


  • ভারতের পণ্ডিত তহবিল (Consolidated Fund of India) এবং জরুরিকালীন তহবিল (Contingency Fund) থেকে আদান প্রদান সংক্রান্ত বিষয়।


  • ভারতের সঞ্চিত তহবিল বা আকস্মিক তহবিল থেকে অর্থ বিনিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়।


  • কোনাে ব্যাংকে সঞ্চিত তহবিলের ব্যয় হিসেবে গণ্য করা বা এরূপ ব্যয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি করা সংক্রান্ত বিষয়।


  • সঞ্চিত তহবিল অথবা সরকারি তহবিলের খাতে অর্থ গ্রহণ এবং গৃহীত ওই অর্থের তত্ত্বাবধান এবং ইউনিয়ন বা কোনাে রাজ্যের হিসাবপরীক্ষা সংক্রান্ত বিষয়।


  • উপরোক্ত (1) থেকে (6) পর্যন্ত বর্ণিত যে-কোনাে বিষয়ের সঙ্গে জড়িত ও প্রাসঙ্গিক কোনাে আর্থিক অঙ্গীকার ও নীতি।


অর্থ বিল সম্পর্কে স্পিকারের মতামত


১১০ (২) নং ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে, জরিমানা বা অন্য কোনাে ধরনের আর্থিক দণ্ড ধার্য করা, লাইসেন্স বা অন্য কোনাে সেবার জন্য ফি ধার্য করা বা কোনাে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক কোনাে কর ধার্য, বিলােপ, পরিহার, পরিবর্তন বা নিয়ন্ত্রণ অর্থ বিলের বিষয়বস্তু বলে পরিগণিত হবে না। অর্থাৎ ওই সকল বিষয়ে কোনাে বিল উত্থাপন করা হলে, সেই বিল অর্থ বিলরূপে পরিগণিত হবে না।


১১০ (৩) নং ধারা অনুযায়ী কোনাে বিশেষ বিলকে অর্থ বিলরূপে গণ্য করা হবে কি না, এই বিষয়ে কোনাে প্রশ্ন উত্থাপিত হলে লােকসভার অধ্যক্ষের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে।


১১০ (৪) নং ধারা অনুযায়ী অর্থ বিল যখন রাজ্যসভায় প্রেরিত হয় অথবা ১১১ নং ধারানুসারে যখন রাষ্ট্রপতির সম্মতির জন্য প্রেরিত হয়, তখন লোকসভার অধ্যক্ষ কে একটি সার্টিফিকেট দিতে হয় যে, সংশ্লিষ্ট বিলটি হল একটি অর্থ বিল।


অর্থ বিলের সুনির্দিষ্ট উদাহরণ : বাজেট, বিনিয়োগ বিল এবং রাজস্ব বিল হল অর্থ বিলের উদাহরণ।


বাজেট: আগামী ১ বছরের জন্য সরকারের আয় ব্যয়ের যে তালিকা তাকে বাজেট বলা হয়। বাজেট হল আগামী এক বছরের জন্য সরকার কর্তৃক রচিত আর্থিক পরিকল্পনা। বাজেটে তিনটি বিষয় থাকে যথা➖ (a) সরকার কোন্ কোন্ উৎস থেকে কত টাকা আয় করবে? কী কী খাতে সেই অর্থ ব্যয় করবে? (b) সরকারের আয় ব্যয় সমান না হলে কোন কোন ক্ষেত্রে নতুন কর বসবে বা পুরােনাে কর ব্যবস্থা বহাল থাকবে কি না সে সম্পর্কিত প্রস্তাব। (c) সরকার কোন কান্ ক্ষেত্র থেকে ঋণ গ্রহণ করবে বা কীভাবে ঋণ পরিশােধ করবে সে সম্পর্কিত প্রস্তাব।


বিনিয়োগ বিল: লোকসভায় ব্যয় বরাদ্দের দাবিসমূহ গৃহীত হওয়ার পর বাজেটে যে-সমস্ত ব্যয় মঞ্জুর করা হয়েছে এবং যে ব্যয় ভারতের সঞ্জিত তহবিলের উপর ধার্য করা হয়েছে এই দুই ধরনের ব্যয় একত্রিত করে ভারতের সঞ্চিত তহবিল থেকে টাকা ব্যয় করার অনুমতি প্রার্থনা করে যে বিল উত্থাপিত হয়, তাকে সংবিধানের ১১৪ নং ধারা অনুসারে 'বিনিয়োগ বিল' বলা হয়।


রাজস্ব বিল: রাজস্ব বিল হল সরকারের আয়ের প্রধান বা অন্যতম উৎস। বিভিন্ন খাত থেকে সংগৃহীত রাজস্ব যথা আয়কর, সম্পদকর, কোম্পানিকর, আমদানি ও রপ্তানি শুল্ক, বন ও ভূমি থেকে রাজস্ব ইত্যাদি হল রাজস্ব বিল। সংবিধান অনুযায়ী কোনাে বিল অর্থ বিল কি না তা নিয়ে দ্ব্দ বা বিতর্ক বা মতবিরােধ উপস্থিত হলে লোকসভার অধ্যক্ষের সিদ্ধান্ত সেক্ষেত্রে চূড়ান্ত বলে গণ্য করা হয়।


অর্থ বিলের বৈশিষ্ট্য


(1) পার্লামেন্টে অর্থ বিল চূড়ান্তভাবে গৃহীত হওয়ার পর স্পিকারের স্বাক্ষর-সহ সার্টিফিকেট বা প্রমাণপত্র যুক্ত করে রাষ্ট্রপতির চূড়ান্ত স্বাক্ষরের জন্য প্রেরিত হয়। তারপর রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষর দিলে বিলটি আইনে রূপান্তরিত হয়।


(2) অর্থ বিল কেবলাত্র লােকসভায় উত্থাপন করা যায়, রাজ্যসভায় উত্থাপন করা যায় না।


(3) রাষ্ট্রপতির সুপারিশ ছাড়া অর্থ বিল উত্থাপন করা যায় না, রাষ্ট্রপতি অর্থ বিলে সম্মতি দানে বাধ্য থাকেন, তিনি অর্থ বিলে সাধারণ বিলের মতাে কোনাে ভেটো ক্ষমতা প্রয়ােগ করতে পারেন না।


(4) অর্থ বিল রাষ্ট্রপতির সম্মতিসাপেক্ষে কেবলমাত্র অর্থমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী উত্থাপন করতে পারেন।


(5) রাজ্যসভা অর্থ বিল ১৪ দিনের বেশি আটকে রাখতে পারে না।


অর্থ বিল পাসের পদ্ধতি


আইনসভায় অর্থ বিল পাসের পদ্ধতি বিষয়ে সংবিধানের ১০৯ নং ধারায় ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ১০৯ নং ধারায় অর্থ বিল উত্থাপন এবং প্রণয়নের পদ্ধতি আলােচিত হয়েছে। অর্থ বিল পাসের পদ্ধতি অন্যান্য যে-কোনাে সরকারি বিল থেকে আলাদা। সাধারণভাবে অর্থমন্ত্রী বা ওই সংক্রান্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী অর্থ বিল উত্থাপন করে থাকেন। লোকসভায় বিভিন্ন পর্যায়ের মধ্য দিয়ে অর্থ বিলটি গৃহীত হয়। লোকসভায় গৃহীত হওয়ার পর রাজ্যসভার সম্মতির জন্য বিলটিকে রাজ্যসভায় পাঠানাে হয়।


(1) অর্থ বিল কেবলমাত্র লোকসভায় পেশ করা হয়: ১০৯ (১) নং ধারানুসারে কোনাে অর্থ বিল রাজ্যসভায় উত্থাপন করা যায় না। রাষ্ট্রপতির পূর্বানুমতি নিয়ে লোকসভায় কোন মন্ত্রী কর্তৃক অর্থবিল উত্থাপিত হয়। লোকসভায় নির্দিষ্ট দিনে অর্থ বিলের শিরােনাম পাঠের সঙ্গে সঙ্গে অর্থ বিলের প্রথম পাঠ শেষ হয়। প্রথম পাঠের পর অন্যান্য সরকারি বিলের মতাে অর্থ বিলকেও আইন প্রণয়নের দ্বিতীয় ও তৃতীয় পাঠের স্তরসমূহ অতিক্রম করতে হয়। অর্থ বিলকে কোনাে সিলেক্ট কমিটিতে প্রেরণ করতে হয় না। লোকসভায় তৃতীয় পাঠ শেষ হলে অধ্যক্ষের প্রমাণপত্র-সহ অর্থ বিলকে রাজ্যসভায় প্রেরণ করা হয়। মনে রাখা প্রয়ােজন অর্থ বিলকে কোনাে যৌথ কমিটির কাছে প্রদান করা সম্ভব নয়।


(2) লোকসভা কর্তৃক অনুমােদিত অর্থ বিল রাজ্যসভায় সংশােধন ও সুপারিশের জন্য প্রেরণ করা হয়: কোনাে অর্থ বিল লোকসভায় গৃহীত হওয়ার পর তা সুপারিশের জন্য রাজ্যসভায় পাঠানাে হয়। ওই সময় লােকসভার অধ্যক্ষকে একটি সার্টিফিকেট প্রদান করতে হয়, যার মধ্যে অর্থ বিল সংক্রান্ত বিষয় উল্লিখিত থাকে। রাজ্যসভা অর্থ বিল পাওয়ার পর ১৪ দিনের মধ্যে লোকসভার নিকট তার সুপারিশ পেশ করে। যদিও অর্থ বিলের ক্ষেত্রে লােকসভা রাজ্যসভার যে-কোনাে সুপারিশকেই প্রত্যাখ্যান করতে পারে [১০৯ (২) নং ধারা]। লােকসভা কর্তৃক প্রেরিত অর্থ বিল প্রাপ্তির ১৪ দিনের মধ্যে যদি রাজ্যসভা লোকসভা নিকট তার সুপারিশ প্রেরণ না করে তাহলে ওই বিল উভয় কক্ষ কর্তৃক গৃহীত হয়েছে বলে মনে করা হয় [১০৯ (৫) নং ধারা)।


(3) রাষ্ট্রপতির সম্মতি: রাষ্ট্রপতির সম্মতি ব্যতীত কোনাে অর্থ বিল আইনে পরিণত হয় না। সংসদ কর্তৃক অর্থ বিল গৃহীত হওয়ার পর লোকসভার অধ্যক্ষের সার্টিফিকেট-সহ অর্থ বিল রাষ্ট্রপতির সম্মতির জন্য প্রেরিত হয়। রাষ্ট্রপতির পূর্বানুমতি নিয়েই অর্থ বিল উত্থাপিত হয় বলে তিনি এই অর্থ বিল থেকে তার সম্মতি প্রত্যাহার করতে পারেন না এবং অর্থ বিলে রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষর দিতে বাধ্য থাকেন। এইভাবে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম নাগরিক রূপে পরিচিত রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর লাভ করলে অর্থ বিল ‘আইনে’ পরিণত হয়।


মূল্যায়ন : অর্থ বিলের ক্ষেত্রে লোকসভার ক্ষমতা যতটা তাত্ত্বিক ততটা বাস্তবসম্মত নয়। কারণ➖


(1) অর্থ বিল উত্থাপনের ক্ষেত্রে সাধারণ সদস্যদের ক্ষমতাকে অস্বীকার করা হয়েছে।

(2) লোকসভায় শাসকদলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকার ফলে উত্থাপিত বিল যে অনুমােদিত হবেই সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে।

(3) অর্থ বিল যেহেতু অত্যন্ত জটিল বিষয়, তাই এই বিলের বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা ও মন্তব্য প্রকাশ করার ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সদস্যের মধ্যে প্রয়ােজনীয় জ্ঞানের অভাব পরিলক্ষিত হয়। কারণ তারা রাজনীতিজ্ঞ, বিশেষজ্ঞ নন।

(4) অর্থ বিল আলােচনার জন্য যে সময় নির্দিষ্ট করা রয়েছে তা বিল পাসের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত নয়।

পরিশেষে বলা যায়, অর্থ বিল পাসের ক্ষেত্রে লােকসভার থেকে মন্ত্রীসভাই অধিক ক্ষমতা ভােগ করে থাকে।


পার্লামেন্টের সদস্যদের বিশেষাধিকার সম্পর্কে আলােচনা করাে।


ভারতীয় সংসদে বিরােধীদলের ভূমিকা আলােচনা করাে।


ভারতের সংসদে আইন পাসের পদ্ধতি | ভারতীয় পার্লামেন্টের আইন পাসের পদ্ধতি