ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মন্ত্রীসভার সম্পর্ক | মন্ত্রীপরিষদের নেতা হিসেবে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা

ভূমিকা: প্রধানমন্ত্রী হলেন ভারত সরকারের শাসকপ্রধান। সংবিধানের ৭৪ নং ধারা অনুসারে প্রধানমন্ত্রী হলেন মন্ত্রীপরিষদের নেতা এবং মন্ত্রীসভার মূল ভিত্তি। তাকে কেন্দ্র করেই মন্ত্রীসভার উত্থান ও পতন লক্ষ করা যায়। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সমমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের মধ্যে অগ্রগণ্য বলে অভিহিত করা হলেও কার্যক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রীপরিষদ ও ক্যাবিনেটের চরম নিয়ন্ত্রক হিসেবে ভূমিকা পালন করে থাকেন।


প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীপরিষদের সম্পর্ক

(১) মন্ত্রীদের নিয়ােগের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা: মন্ত্রীসভা গঠনে কার্যত প্রধানমন্ত্রীই সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মন্ত্রীসভার অন্যান্য মন্ত্রীগণ প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হন [ ৭৫ (১) নং ধারা ]। তবে মন্ত্রীসভার সদস্যদের নিয়ােগ করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী নিজ ইচ্ছা অনুযায়ী যা খুশি তাই করতে পারেন না। আবার কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রীসভার কোনাে কোনাে সদস্য যেমন ক্যাবিনেট মন্ত্রী, রাষ্ট্রমন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রীদেরকে নিযুক্ত করার ক্ষেত্রে তার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত প্রয়ােগ করে থাকেন। তাকে বিশেষ কয়েকটি বিষয়ে দৃষ্টি রাখতে হয়, যেমন―

  • নিজ দলের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা মন্ত্রীসভায় স্থান পাচ্ছেন কি না,
  • সব রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলি থেকে তার দলের প্রতিনিধিরা মন্ত্রীত্ব করার সুযােগ পাচ্ছেন কি না,
  • তপশিলি জাতি, উপজাতি ও অনগ্রসর সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা স্থান লাভ করছেন কিনা,
  • তার দলের তরুণ, লড়াকু নেতা যাতে স্থান পান প্রভৃতি।

তবে জোট সরকার হলে মন্ত্রীসভা গঠনে শরিক দলের দাবিদাওয়ার উপর প্রধানমন্ত্রীকে গুরুত্ব দিতে হয়। অতীতে দেখা গেছে রাজনৈতিক প্রভাব ছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর অনুগ্রহভাজন হলে মন্ত্রীসভায় স্থান লাভ করা যায়, যেমন রাজিব গান্ধী মন্ত্রিসভায় অরুণ নেহরু স্থান পেয়েছিলেন।


(২) মন্ত্রীদের পদচ্যুতির ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা: মন্ত্রীসভার সদস্যদের পদচ্যুতির ক্ষেত্রেও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। মন্ত্রীসভার কোনাে মন্ত্রীর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর নীতিগত বিরােধ দেখা দিলে প্রধানমন্ত্রী সেই মন্ত্রীকে সংশ্লিষ্ট পদ থেকে বহিষ্কার করতে পারেন। যদি এক্ষেত্রে কোনাে মন্ত্রী পদত্যাগ করতে না চায় তাহলে প্রধানমন্ত্রী সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীকে মন্ত্রীসভার ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হওয়ার অভিযােগ তুলে পদত্যাগ করতে বাধ্য করতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, ২০১০ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে কেন্দ্রীয় বিদেশ প্রতিমন্ত্রী শশী থারুরকে মনমোহন সিং-এর মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। কোর গ্রুপের দীর্ঘ বৈঠকের পর কোনাে মন্ত্রীকে পদত্যাগের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা তার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত প্রয়ােগ করে থাকে।


(৩) মন্ত্রীসভা পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা: মন্ত্রীসভার প্রধান রূপে মন্ত্রীদের মধ্যে দপ্তর বণ্টন, পুনর্বণ্টন, দপ্তর পরিবর্তন প্রভৃতি ক্ষেত্রেও প্রধানমন্ত্রীর প্রভূত ক্ষমতা আছে। বলা হয় যে, প্রধানমন্ত্রী তার ইচ্ছানুযায়ী মন্ত্রীসভার রদবদল ঘটাতে পারেন (The Prime Minister can shuffle the pack as he please.") প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কোনো মন্ত্রীর মতভেদ হলে প্রধানমন্ত্রী তাকে পদত্যাগ করতে বলতে পারেন। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর অপসারণের জন্য তিনি রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দিতে পারেন। মন্ত্রীরা সর্বদাই প্রধানমন্ত্রীর অনুগত হয়ে থাকেন। মন্ত্রীসভার সমস্ত কাজকর্ম তারই নির্দেশে পরিচালিত হয়ে থাকে। মন্ত্রীসভার সমস্ত সিদ্ধান্তে প্রধানমন্ত্রীর প্রভাব লক্ষ করা যায়। এরজন্যই মন্ত্রীসভার প্রথম এবং প্রধান ব্যক্তি হলেন প্রধানমন্ত্রী।


(৪) মন্ত্রীসভা ও ক্যাবিনেটের সভাপতি হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা: প্রধানমন্ত্রী হলেন ক্যাবিনেটের সভাপতি। তিনি হলেন মন্ত্রীসভার মধ্যমণি। তাকে বলা হয় ক্যাবিনেট তােরণের ভিত্তিপ্রস্তর (Keystone of the Cabinet arch) ড. মহাজনের মতে, তিনি হলেন অনেক তারকারাজির মধ্যে চন্দস্বরূপ ("he is the moon among the stars.”)। প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রীসভার বৈঠক আহ্বান করেন এবং ওই সভার কর্মসূচি নির্ধারণ করেন। প্রধানমন্ত্রী প্রয়ােজন মনে করলে তার কয়েকজন ঘনিষ্ঠ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীদের নিয়ে যে-কোনাে দিন যে-কোনাে সময় কিংবা একদিনে একাধিকবার বৈঠক ডাকতে পারেন। প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রী পরিষদের আলােচ্যসূচি তৈরি করে দেন। কোনাে মন্ত্রী কোনাে বিষয়ে আলােচনায় ইচ্ছুক হলে তিনি তা ক্যাবিনেটের সচিবালয়ের কাছে লিখিতভাবে পেশ করেন এবং ক্যাবিনেট তা মন্ত্রীদের কাছে প্রচার করেন। তবে প্রধানমন্ত্রীর অনুমােদন ছাড়া কোনাে বিষয়সূচিকে ক্যাবিনেটের আলােচনায় অন্তর্ভুক্ত করা যায় না।


(৫) সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও কার্যাবলি রূপায়ণের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা: রাষ্ট্রপতি মন্ত্রীসভার পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করে থাকেন। মন্ত্রীসভার পক্ষে রাষ্ট্রপতিকে সেই পরামর্শ প্রধানমন্ত্রীই দিয়ে থাকেন। মন্ত্রীসভার সমস্ত সিদ্ধান্ত ও কার্যাবলি সম্পর্কে রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রীই জানান এবং এগুলির মধ্যে তাঁরই প্রভাব পরিস্ফুট হয়ে থাকে। মন্ত্রীসভার সঙ্গে রাষ্ট্রপতির সম্পর্কের ক্ষেত্রে তিনিই হলেন প্রধান সংযােগসূত্রকারক।


(৬) মন্ত্রীসভার বিভিন্ন দপ্তরের মধ্যে সংযােগসাধনকারী হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা: প্রধানমন্ত্রী হলেন রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রীপরিষদের সংযােগসাধনকারী। প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রীসভার যাবতীয় সিদ্ধান্ত একদিকে রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করেন, অন্যদিকে আবার রাষ্ট্রপতি কোনাে বাণী প্রেরণ করলে তিনি তা পরিষদকে অবহিত করেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে যে, ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ও রাজা-রানিও তাদের মন্ত্রী পরিষদের সঙ্গে যােগসূত্রকারক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন। এখানে উল্লেখ্য যে, বিভাগীয় মন্ত্রীরা তাদের দায়িত্ব সম্পাদনের ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে মতামত জানালে কার্যত তারা প্রধানমন্ত্রীর বিরােধিতা করে কোনাে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন না।


পর্যালােচনা: ভারতে বিগত কয়েক দশক ধরে মন্ত্রীসভা গঠন, পুনর্গঠন, মন্ত্রীদের মধ্যে দপ্তর বন্টন, পুনর্বণ্টন, দপ্তর পরিবর্তন এবং অপসারণের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত ইচ্ছাই চূড়ান্ত রূপ পাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী নিজেই বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। তিনি সেই সিদ্ধান্তগুলি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীবর্গকে মানতে বাধ্য করছেন। সরকার বলতে এখন কার্যত প্রধানমন্ত্রীকে বােঝানাে হয়। প্রকৃত প্রস্তাবে মন্ত্রীসভা এবং ক্যাবিনেট বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শদাতায় পরিণত হয়েছে। মন্ত্রীসভার যৌথ দায়িত্বের পরিবর্তে একক দায়িত্ব প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। কেউ কেউ অবশ্য বলেন মন্ত্রীদের ব্যক্তিত্বহীনতা, অযােগ্যতা এর জন্য দায়ী। তবে কোনাে প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রীসভায় কতটা প্রভুত্বের অধিকারী হবেন তা তার নিজস্ব যােগ্যতা, ব্যক্তিত্ব, রাজনৈতিক দক্ষতা, বিচক্ষণতা ইত্যাদির উপর নির্ভর করে।


উপসংহার: সমগ্র মন্ত্রীসভার উপর প্রধানমন্ত্রীর সর্বব্যাপী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য ড. বি আর আম্বেদকর তাকে ক্যাবিনেট তােরণের প্রধান স্তম্ভ বলে অভিমত প্রকাশ করেছিলেন। ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের কাঠামােতে এ কথা সত্য। তবে ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দের আগে পর্যন্ত, যখন ভারতে প্রভুত্বকারী দলীয় ব্যবস্থা কার্যকরী ছিল সেই সময়ের প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীসভার যেরূপ সম্পর্ক ছিল, তার পর বিভিন্ন আঞ্চলিক দলগুলির উদ্ভবের পর বিশেষ করে নব্বই-এর দশকের পর থেকে সেই সম্পর্কের অনেক পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। জওহরলাল নেহরু, ইন্দিরা গান্ধি মন্ত্রীসভার উঃ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে যতখানি সক্ষম হয়েছিলেন, লালবাহাদুর শাস্ত্রী, নরসিমহা রাও, দেবেগৌড়া, মনমোহন সিং প্রমুখরা মন্ত্রীসভার উপর ততখানি প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হননি।


কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার গঠন এবং মন্ত্রীসভার ক্ষমতা ও কার্যাবলি | ভারতের ক্যাবিনেটের প্রধান কার্যাবলি | কেন্দ্রীয় মন্ত্রীপরিষদের গঠন, ক্ষমতা ও কার্যাবলি


ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ও পদমর্যাদা | ভারতীয় প্রজাতন্ত্রে প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা | ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাজগুলির বিবরণ দাও ও তাঁর সাংবিধানিক ভূমিকা ব্যাখ্যা করাে।


ভারতের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে সম্পর্ক | সংবিধানে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সম্পর্ক