উদারনীতিবাদের সংজ্ঞা দাও। সংকীর্ণ ও ব্যাপক অর্থে উদারনীতির ধারণা বিশ্লেষণ করাে।

উদারনীতিবাদের সংজ্ঞা

উদারনীতিবাদের ইংরেজি প্রতিশব্দ হল Liberalism'। এই শব্দটি সৃষ্টি হয়েছে স্পেনের রাজনৈতিক দল 'Liberals'-এর নামানুসারে। আবার ব্যুৎপত্তিগত বিচারে 'Liberalism'-এর অর্থ হল Liberty বা স্বাধীনতা। সুদীর্ঘ তিন শতক (সপ্তদশ থেকে উনবিংশ শতক) ধরে নানান অর্থ ও ব্যঞ্জনায় উদারনীতিবাদ রাজনৈতিক চিন্তার জগতে উপস্থিত হয়েছে। তাই এই মতবাদের নির্দিষ্ট কোনাে সংজ্ঞা দেওয়া কঠিন। তবে সাধারণভাবে বলা যায় যে, সব ধরনের কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে যে মতবাদ ব্যক্তিগত জীবনে। স্বাধীন চিন্তা, বিশ্বাস ও মতপ্রকাশের উপর গুরুত্ব আরোপ করে এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার ব্যক্তিত্ব বিকাশের প্রধান উপায় বলে মনে করে এবং সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে স্বাধীন মৌলিক নীতি প্রতিষ্ঠার দাবি জানায়, তাকে উদারনীতিবাদ বলে অভিহিত করা যায়। Encyclopaedia Britannica তে বলা হয়েছে যে, উদারনীতিবাদ এমন একটি ধারণা, যা সমাজ ও সরকারের কার্যপ্রণালী হিসেবে এবং ব্যক্তি ও সমাজের একটি জীবনাদর্শ (a way of Life) হিসেবে, সামাজিক গঠন সম্পর্কিত নীতি হিসেবে স্বাধীনতাকে প্রতিষ্ঠার দাবি জানায়।


তবে এককথায় উদারনীতিবাদ হল একটি স্বাধীন জীবনের ভাবাদর্শ আর এই মতবাদ হল রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ববাদ বিরােধী, ব্যক্তিস্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার মতবাদ। হবহাউস তার Liberalism’শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন, উদারনীতিবাদ হল এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গি যা এমন কতকগুলি সামাজিক শর্ত গড়ে তুলতে চায়, যার দ্বারা সকল মানুষের ব্যক্তিত্বের সর্বোত্তম বিকাশ ঘটতে পারে। হ্যারল্ড ল্যাস্কির মতে, উদারনীতিবাদ হল সমসাময়িক কালের উপযােগী এমন একটি মতাদর্শ যার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হল স্বাধীনতা। অধ্যাপক স্যাবাইনের মতানুসারে সংকীর্ণ ও ব্যাপক উভয় অর্থেই উদারনীতির ধারণা প্রযুক্ত হয়।


সংকীর্ণ অর্থে উদ্দারনীতির ধারণা


সংজ্ঞা: সংকীর্ণ অর্থে উদারনৈতিক মতবাদকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ধারণা হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়। রাজনৈতিক উদারনীতিবাদের সার কথা হল প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থা, নাগরিকের ভোটাধিকার, সরকারি ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা প্রভৃতি। অপরদিকে অর্থনৈতিক উদারনীতিবাদের মূল কথা হল অর্থনীতির ক্ষেত্রকে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণমুক্ত রাখা। বলাবাহুল্য, সংকীর্ণ অর্থে উদারনীতিবাদ রক্ষণশীলতা ও সমাজতন্ত্রের মধ্যবর্তী অবস্থানে অবস্থিত।


উদ্দেশ্য: সংকীর্ণ অর্থে উদারনীতিবাদের প্রধান উদ্দেশ্য হল অর্থনৈতিক ক্ষেত্রকে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে রাখা এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের শাসক প্রতিনিধিদের নির্বাচন ও অপসারণের ব্যাপারে নাগরিকদের ব্যক্তি স্বাধীনতাকে সর্বোচ্চ স্থানে প্রতিষ্ঠা করা। তা ছাড়াও এই অভিব্যক্তি ব্যক্তিমানুষের ব্যক্তিত্বের মূল্যায়ন করতে চায়। ব্যক্তিত্বকে সমাজের কাছে মূল্যবান করে তুলে ধরতে এবং ব্যক্তির স্বাধীন অভিব্যক্তির বিকাশ ও সংরক্ষণের সহায়ক নীতি ও প্রতিষ্ঠানসমূহকে তুলে ধরতে চায়। অর্থাৎ এককথায় উদারনৈতিক মতবাদের উদ্দেশ্য হল উৎপাদন, বণ্টন এবং বিনিময় ব্যবস্থায় অবাধ প্রতিযােগিতা ও ব্যক্তিগত উদ্যোগকে সুরক্ষিত রাখা।


ব্যাপক অর্থে উদারনীতির ধারণা


সংজ্ঞা: ব্যাপক অর্থে উদারনীতি হল এমন এক মানসিক ধারণা যে ব্যক্তির অধিকার, স্বাধীনতা এবং ব্যক্তিত্বের সর্বাঙ্গীণ বিকাশের পক্ষপাতী। অর্থাৎ উদারনীতিবাদ মানুষের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবন ছাড়াও সামাজিক, ধর্মীয়, নৈতিক ও বৌদ্ধিক জীবন নিয়েও আলােচনা করে। উদারনীতিবাদ মানুষকে ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কার ও অর্থহীন অভ্যাস থেকে মুক্ত করতে চায়। মূলত, বিশ্বাসের বদলে যুক্তির উপর গুরুত্ব আরােপ করাই এই তাত্ত্বিক গােষ্ঠীর কাম্য। ব্যাপক অর্থে উদারনীতিবাদ সমাজ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বিপ্লবের পরিবর্তে বিবর্তনের পদ্ধতিতে বিশ্বাসী।


উদ্দেশ্য: ব্যাপক অর্থে উদারনীতিবাদের উদ্দেশ্য হল সব ধরনের একনায়কতন্ত্র ও কর্তৃত্ব বাদের বিরােধিতা করা এবং গণতন্ত্রের প্রসার ঘটানাে। ব্যাপক অর্থে উদারনীতিবাদের লক্ষ্য হলো ব্যক্তির অধিকার, স্বাধীনতা (পৌর স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা, পারিবারিক স্বাধীনতা, আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং জনগণের সার্বভৌমিকতা) ও ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটানাে। আধুনিক উদারনীতির ব্যাখ্যায় আইনশৃঙ্খলা সমেত অন্যান্য ক্ষেত্রেও মূল রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণকে স্বীকার করা হয়।


উপসংহার: উপরোক্ত আলােচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, এই মতবাদ সব ধরনের কুসংস্কার, গোঁড়ামি ও অন্ধবিশ্বাসের পরিবর্তে যুক্তির দ্বারা সব কিছুকে বিচার করতে চায়। সামাজিক ক্ষেত্রে নিরঙ্কুশ রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব ও হস্তক্ষেপের বিরােধিতা করা ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উৎপাদন বন্টন ও বিনিময় ব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের অবসান ও অবাধ প্রতিযােগিতা উদারনীতিবাদের মূল উদ্দেশ্য। সংকীর্ণ ও ব্যাপক উভয় ধরনের উদারনীতির ব্যাখ্যার মূল উদ্দেশ্য হল স্বাধীনতা। তাই এককথায় উদারনৈতিক মতবাদ হল স্বাধীনতার মতবাদ।


প্রযুক্তিগত বিপ্লব এবং কাঠামােগত বিন্যাস বিশ্বায়নের এই দুটি দিক রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতাকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করেছে বলে তুমি মনে করাে?


বিশ্বায়নের প্রভাবে ভারতের অর্থনৈতিক সংস্কারসমূহ আলােচনা করাে।


উদারনীতিবাদের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ আলােচনা করাে।