মার্কসবাদের মূলনীতি বা মূল সূত্র | মার্কসবাদের মূল সূত্র বা মূল উপাদানসমূহ

ভূমিকা: পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত যতজন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রদার্শনিকের জন্ম হয়েছে তাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হলেন কার্ল মার্কস (১৮১৮-১৮৮৩ খ্রি.)। এককথায় কার্ল মার্কসের চিন্তা ভাবনা এবং দর্শনের বলা হয় মার্কসবাদ। তবে মার্কসবাদ বলতে কেবলমাত্র কার্ল মার্কস-এর বক্তব্যকে বােঝায় না। ফ্রেডারিক এঙ্গেলস, লেনিন, স্তালিন, মাও-জেদং এবং গ্রামসি প্রমুখের চিন্তাধারা মার্কসবাদকে আরও সমৃদ্ধ করে। কার্ল মার্কস এবং ফ্রেডারিক এঙ্গেলস হলেন মার্কসবাদের আদি এবং মুখ্য প্রবক্তা। যাইহােক এমিল বার্স-এর ভাষায় মার্কসবাদ হল আমাদের এই জগৎ এবং তার অংশ মানবসমাজ সম্পর্কে একটি সাধারণ তত্ত্ব। আর লেনিনের ভাষায় কার্ল মার্কসের দৃষ্টিভঙ্গি এবং শিক্ষামালার নামই হল মার্কসবাদ।


উনবিংশ শতাব্দীর মধ্য ও শেষ ভাগে কার্ল মার্কস ও ফ্রেডারিক এঙ্গেলস একযােগে এই তত্ত্ব রচনা করেন। ফ্রেডারিক এঙ্গেলসের সহযােগিতায় কার্ল মার্কস মানব ইতিহাসের জড়বাদী বিশ্লেষণ করে যে বিজ্ঞানসম্মত দার্শনিক তত্ত্ব উপস্থিত করেন, তা-ই মার্কসবাদ নামে পরিচিত।


মার্কসবাদের মূল সূত্র বা মূলনীতি বা মূল উপাদানসমূহ

(১) দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ: মার্কসবাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ। কার্ল মার্কসের দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ হেগেলের দ্বন্দ্বমূলক ভাববাদের সম্পূর্ণ বিপরীত। কার্ল মার্কসের দ্বন্দমূলক বস্তুবাদের মূল কথা হল এই জগৎ বস্তায়। জগতের প্রতিটি বস্তু পরস্পর পরস্পরের উপর নির্ভরশীল এবং এই বস্তুজগৎ অনড় বা অচল নয়, তা সর্বদা পরিবর্তনশীল। প্রতিটি বস্তু ও ঘটনার মধ্যে পরস্পরবিরােধী ধর্ম বিদ্যমান থাকে, সেগুলি হল বাদ (Thesis), প্রতিবাদ (Anti thesis) এবং সম্বাদ(Synthesis)। মার্কসের মতে, উৎপাদনশক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের পরিবর্তনের জন্যই সমাজ ও রাষ্ট্রীয় কাঠামাে পরিবর্তিত হয়।

  • বৈপরীত্যের দ্বন্দ্ব: দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ অনুসারে, প্রতিটি বস্তু ও ঘটনার মধ্যে পরস্পরবিরােধী ধর্ম বর্তমান এবং তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বা বিরােধই বস্তুর পরিবর্তন ঘটায় বা সমাজ পরিবর্তনের মূল কারণ। যেমন— পুঁজিবাদী সমাজে পুঁজিপতি মালিক ও শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব সমাজ পরিবর্তনের মূল কারণ। প্রতিটি বস্তু ও ঘটনার মধ্যে একসঙ্গে পরস্পর বিরোধী ধর্ম কাজ করে। যেমন (—,-= +) দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ অনুসারে, বৈপরীত্যের দ্বন্দ্ব বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। যেমন বৈর ও অবৈর দ্বন্দ্ব, অন্তদ্বন্দ্ব ও বহি দ্বন্দ্ব প্রভৃতি।
  • বস্তুর পরিমাণগত পরিবর্তনের সঙ্গে গুণগত পরিবর্তন সাধিত হয়: এই তত্ত্ব অনুযায়ী, অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব বস্তুতে প্রতিনিয়ত পরিমাণগত পরিবর্তন ঘটিয়ে চলে, যা শেষপর্যন্ত গুণগত পরিবর্তন ঘটায়। পরিবর্তনের একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে এসে তার বৈপ্লবিক রূপান্তর ঘটার ফলে সমাজে বিকাশ ঘটে। মার্কসের মতে, পুঁজিবাদী সমাজের পরিমাণগত পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় বিপ্লবের মাধ্যমে গুণগত পরিবর্তন ঘটিয়ে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার সৃষ্টি হয়। দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ায় বিপরীতধর্মী শক্তির দ্বন্দ্বের ফলে বস্তুর পরিমাণগত পরিবর্তন থেকে গুণগত পরিবর্তন ঘটে।
  • নেতির নেতিকরণ বা অস্বীকৃতির অস্বীকৃতি: পুরােনােকে অস্বীকার না করলে নতুনের আবির্ভাব ঘটে না। নতুন  ক্রমে পুরােনাে হয় এবং তার পরিবর্তন ঘটে, জন্ম হয় অধিকতর নতুনের। এভাবেই দাস সমাজব্যবস্থাকে অস্বীকার করে সামন্ত সমাজ, সামন্ত সমাজকে অস্বীকার করে পুঁজিবাদী সমাজ, আবার পুঁজিবাদী সমাজকে অস্বীকার করে সমাজতান্ত্রিক সমাজের বিকাশ ঘটে।


(২) ঐতিহাসিক বস্তুবাদ: মার্কসবাদ অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল ঐতিহাসিক বস্তুবাদ। সমাজ জীবনের অনুশীলনে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের মূলনীতিসমূহের প্রয়ােগকে বলা হয় ঐতিহাসিক বস্তুবাদ। ঐতিহাসিক বস্তুবাদ সমাজ ও তার বিভিন্ন সংগঠনের বিকাশের ইতিহাসকে ব্যাখ্যা করেই ক্ষান্ত হয় না, এই তত্ত্ব ভবিষ্যৎ সমাজ ব্যবস্থা কেমন হবে সে সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা করে। এঙ্গেলস বলেছেন, ডারউইন যেমন জীবজগতের বিবর্তনের সূত্রটি আবিষ্কার করেছেন, তেমনিভাবে মার্কস আবিষ্কার করেছেন মানব ইতিহাসের বৈজ্ঞানিক মূলসূত্রসমূহ।

  • মূল বন্তব্য: ঐতিহাসিক বস্তুবাদের মূল কথা হল আদিম সাম্যবাদী সমাজ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত যত ধরনের সমাজব্যবস্থার ইতিহাস দেখা গেছে তাদের সকলের ইতিহাস হল শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস। এই সংগ্রামের মূল কারণ শােষক ও শােষিতের মধ্যে অর্থনৈতিক স্বার্থের সংঘাত। অর্থনীতি হল মূল চালিকাশক্তি। মানবসমাজের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অন্যান্য বিষয়গুলি অর্থনীতির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। অর্থনীতি হল সমাজের ভিত বা বুনিয়াদ (Base), আইন, ধর্ম-বিচার বিভাগ বা আদালত এবং কলা, সাহিত্য এগুলি হল উপরিকাঠামো। অর্থনীতি দাঁড়িয়ে থাকে উৎপাদন ব্যবস্থার উপর। উৎপাদন ব্যবস্থার দুটি দিক প্রকৃতি এবং শ্রমশক্তি। আবার উৎপাদন পদ্ধতির দুটি দিক一 (1) উৎপাদিকা শক্তি: উৎপাদিকা শক্তি বলতে শ্রমশক্তি এবং যন্ত্র শক্তিকে বােঝায় এবং (2) উৎপাদন সম্পর্ক: উৎপাদন সম্পর্ক বলতে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় মানুষে-মানুষে, শ্রমিক-মালিকের মধ্যে সম্পর্ককে বােঝায়।
  • সমাজ পরিবর্তালর কারণ: কার্ল মার্কস ঐতিহাসিক বস্তুবাদের ব্যাখ্যায় জানিয়েছেন যে, উৎপাদন পদ্ধতির দুটি অংশ অর্থাৎ উৎপাদিকা শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের দ্বন্দ্বের ফলে সমাজ পরিবর্তিত হয়। উদাহরণস্বরূপ মার্কস বলেছেন যে, আদিম সাম্যবাদী সমাজে উৎপাদনের উপর কোনাে ব্যক্তিগত মালিকানা ছিল না তাই শ্রেণিভেদ বা শ্রেণিশােষণ ছিল না। কিন্তু পরবর্তীকালে দাস সমাজে দাস মালিকরা উৎপাদনের উপাদানের উপর ব্যক্তিগত মালিকানা সৃষ্টি করে তারপর কালক্রমে বিপ্লব বা বিদ্রোহের মাধ্যমে সামন্তপ্রভু পরে পুঁজিপতিদের হাতে চলে আসে এইসময়ে উৎপাদন ব্যবস্থায় উৎপাদন পদ্ধতির দুটি অংশের মধ্যে ক্রমাগত দ্বন্দ্ব চলতেই থাকে, এইভাবে দ্বন্দ্বের মাধ্যমে সমাজের পরিবর্তন ঘটে।
  • উদ্বৃত্ত মূল্য তত্ত্ব: উদ্বৃত্ত মূল্যতত্ত্ব হল মার্কসবাদের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক তত্ত্ব। পুঁজিবাদী সমাজে পুঁজিবাদী যে পুঁজি তৈরি করে এবং শ্রমিককে শােষণ করে তার অন্যতম মাধ্যম হল উদ্বৃত্ত মূল্য বা Surplus Value। মার্কসের মতে, কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি ও শ্রমের সংমিশ্রণে যে দ্রব্য উৎপাদিত হয়, তা শ্রমিকের শ্রমের ফসল। শ্রমিকরা জীবনধারণের জন্য শ্রম বিক্রি করে কিন্তু সারাদিনের শ্রমে শ্রমিক যা উৎপাদন করে, সেই মূল্যের মাত্র সামান্য একটি অংশ সে মজুরি হিসেবে পায়। বলা যেতে পারে, উৎপাদিত দ্রব্যের মূল্য থেকে যে বেশি পরিমাণ মূল্য শ্রমিককে দেওয়া হয় না, তাই হল উদ্বৃত্ত মূল্য। এই উদ্বৃত্ত মূল্য হল পুঁজিপতিদের মুনাফার উৎস। এই উদ্বৃত্ত মূল্য আত্মসাৎ করে পুঁজিবাদীরা শ্রমিককে শােষণ করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় (মােট শ্রম সময়ে সৃষ্ট পণ্যমূল্য মােট শ্রম সময়ের মূল্য)।


(৩) শ্রেণিসংগ্রাম তত্ত্ব: মার্কসবাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল শ্রেণিসংগ্রাম তত্ত্ব। কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’-তে কার্ল মার্কস বলেছেন যে, আজ পর্যন্ত যত সমাজ দেখা গেছে তাদের সকলের ইতিহাস হল শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস। আদিম সাম্যবাদী সমাজে কোনােরকম ব্যক্তিগত সম্পত্তির অস্তিত্ব না থাকায় সেই সমাজে কোনোরূপ শ্রেণিদ্বন্দ্ব বা সংঘর্ষ ছিল না। কিন্তু পরবর্তীকালে ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্ভব হওয়ায় শ্রেণিসংগ্রাম তীব্র আকার ধারণ করে। ইতিহাসে বিভিন্ন সময়ে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও জার্মানিতে শ্রেণিসংগ্রাম ঘটে। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ায় লেনিনের নেতৃত্বে অক্টোবর বিপ্লব হয় এবং সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।


কার্ল মার্কসের শ্রেণিসংগ্রাম তত্ত্বের মূল কথা হল যে, আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে যত সমাজ দেখা গছে (দাস সমাজ, সামন্ত সমাজ, পুঁজিবাদী সমাজ, আদি সাম্যবাদী সমাজ বাদে) তার প্রত্যেকটিতেই মালিক এবং শ্রমিক এই দুটি পরস্পরবিরােধী শ্রেণির অস্তিত্ব দেখা যায়। এই দুটি শ্রেণির মধ্যে পুজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা দ্বন্দ্ব তীব্রতর হয়। শ্রমিক বা সর্বহারা শ্রেণি পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার ধ্বংসের জন্য অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও আদর্শগত সংগ্রাম চালাতে থাকে। শেষপর্যন্ত পুজিপতি বা সর্বহারা শ্রেণির একনায়কত্বে শ্রেণীহীন, শােষণহীন সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়।


(৪) রাষ্ট্র সম্পর্কিত তত্ত্ব: কার্ল মার্কস মনে করেন রাষ্ট্র কোনাে চিরন্তন শাশ্বত প্রতিষ্ঠান নয় এবং কোনাে কল্যাণকামী প্রতিষ্ঠান নয়, রাষ্ট্র হল বল বা শক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত একটি কৃত্রিম প্রতিষ্ঠান। প্রাচীনকালে রাষ্ট্র ছিল না। আদিম সাম্যবাদী সমাজ ছিল রাষ্ট্রহীন। পরবর্তীকালে ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্ভব হওয়ায় মানুষে মানুষে মতভেদ (দ্বন্দ্ব) বা শ্রেণিদ্বন্দ্বের সৃষ্টি হলে শােষণ ও বলপ্রয়ােগের প্রয়ােজন হয় বলেই সমাজে এক বিশেষ শক্তি হিসেবে মানুষই রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করে। তাই এঙ্গেলস বলেছেন, শ্রেণিগত বৈষম্যের কারণে শক্তির প্রতীক হিসেবে রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়েছে। তার ভাষায়, পশুশক্তির উপর ভিত্তি করে রাষ্ট্র নামক সংগঠন সৃষ্টি হয়েছে ("The State became a necessity because of this cleavage")

  • রাষ্ট্র হল শ্রেণিশােষাণর যন্ত: মার্কস-এর মতে, রাষ্ট্র হল শ্রেণিশােষণের যন্ত্র। তার মতে, সমাজজীবনের শুরু থেকে রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়নি। সমাজের অর্থনৈতিক বিবর্তনের এক বিশেষ পর্যায়ে সমাজ যখন সম্পত্তিবান শােষক এবং সম্পত্তি হীন শােষিত শ্রেণি, এই দুই পরস্পরবিরােধী শ্রেণিতে বিভক্ত হয়ে পড়ল, তখন থেকেই শুরু হল এই দুই শ্রেণির মধ্যে দ্বন্দ্ব। সম্পত্তি মালিকানার নিরাপত্তার জন্য যে বলপ্রয়ােগের হাতিয়ারের প্রয়ােজন হয়, তা হল রাষ্ট্র। সংখ্যালঘু সম্পত্তি বান শ্রেণি সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্পত্তি হীন শ্রেণিকে রাষ্ট্রের মাধ্যমে শােষণ করে।


মার্কসবাদীদের মতে, বিপ্লবের মাধ্যমে একসময় সর্বহারা শ্রেণি (সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্পত্তিহীন শ্রেণি) পুঁজিবাদী রাষ্ট্র (সংখ্যালঘুদের শােষণের হাতিয়ার)-কে ধ্বংস করে সর্বহারা শ্রেণির একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করবে। যেখানে রাষ্ট্র শােষণের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করবে না। শ্রেণীহীন, শোষণহীন সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে। শােষণের হাতিয়ার হিসেবে রাষ্ট্রের বিলুপ্তি ঘটবে (The State will wither away) এবং তারপর শ্রেণীহীন, শােষণহীন উন্নততর সাম্যবাদী সমাজের প্রতিষ্ঠা ঘটবে। এই সমাজের মূলনীতি হল প্রত্যেকে তার সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করবে এবং প্রয়ােজন অনুযায়ী ভােগ করবে (From each according to his capacity, to each according to his need)


(৫) বিপ্লব সংক্রান্ত তত্ত্ব: মার্কসবাদের আর-একটি অন্যতম নীতি হল বিপ্লবের তত্ত্ব। সমাজবিজ্ঞানে বিপ্লবের কোনাে সর্বজনস্বীকৃত সংজ্ঞা নেই। বুর্জোয়া তাত্ত্বিকদের মতে, বিপ্লব হল কোনাে আকস্মিক ও হিংসাত্মক পদ্ধতিতে সরকারের পরিবর্তন প্রক্রিয়া। অর্থাৎ প্রচলিত সমাজব্যবস্থাকে ভেঙে বলপূর্বক একটি সরকারের পরিবর্তে অপর একটি সরকার গঠন অথবা এক শ্রেণির হাত থেকে অপর শ্রেণির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরই হল বিপ্লব। মার্কসবাদীদের মতে, বিপ্লব হল এমন একটি ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন সংঘটিত হয়, এক শাসকশ্রেণির পরিবর্তে অন্য এক প্রগতিশীল শাসকশ্রেণি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়।


এককথায় বিপ্লবের অর্থ হল পরিবর্তন, মার্কসবাদ অনুযায়ী বিপ্লব হল এমন এক সামাজিক প্রক্রিয়া যার প্রভাবে পুরােনাে সমাজ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে তার ধ্বংসস্তুপের উপর নতুন সমাজ গড়ে তােলার জন্য সমাজে বিপ্লব ঘটে। এককথায় শ্রেণি বৈষম্যমূলক সমাজের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের ফলেই বিপ্লব দেখা দেয়, বিপ্লব হল ইতিহাসের চালিকাশক্তি বা ধাত্রী (Locomotive Force)। মার্কসীয় মতে, বিপ্লবের ফলে সবরকম সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক শােষণের অবসান ঘটে এক শােষণমুক্ত শ্রেণিহীন সমাজ গঠন হবে। লেনিনের মতে, বিপ্লব হিংসার তাণ্ডব নয়, বিপ্লব হল উৎপীড়িত ও শোষিতের মহােৎসব।


উপসংহার: মার্কসবাদের উপরোক্ত মূলসূত্র বা উপাদান বা নীতিগুলি বিশ্লেষণ করার পর এ কথা বলাবাহুল্য যে, বর্তমান দুনিয়ায় এখনও পর্যন্ত অভিশপ্ত মেহনতি গরিব, শ্রমজীবী মানুষের দুঃখ কষ্টের অভিশাপের কবল থেকে মুক্তির জন্য মার্কসবাদ হল বাঁচার একমাত্র পথ। কেননা মার্কসবাদ হল একটি বিশ্ববীক্ষা (World outlook)। মার্কসবাদকে বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সমালােচনা করলে সমাজের শোষিত-বঞ্চিত মানুষের মুক্তির জন্য মার্কস যে পথের দিশা দিয়ে গেছেন তার গুরুত্বকে বর্তমান বিশ্বের কেউই কোনােভাবেই অস্বীকার করতে পারবে না।