রাজ্য আইনসভায় আইন প্রণয়নের পদ্ধতি আলােচনা করাে।

রাজ্য আইনসভায় আইন প্রণয়নের পদ্ধতি

ভারতের সংবিধান অনুসারে সংসদে যে পদ্ধতিতে আইন পাস করা হয়, সেই একই পদ্ধতি রাজ্য আইনসভার ক্ষেত্রেও অনুসরণ করা হয়। যেসব রাজ্যে আইনসভা দ্বিকক্ষযুক্ত, সেখানে বিধান পরিষদেও বিলটি পাস করাতে হয়। অর্থ বিল ছাড়া যে-কোনাে বিল যে-কোনাে কক্ষে উত্থাপন করা যায়। তবে যেসব রাজ্য আইনসভার উচ্চকক্ষের (বিধান পরিষদ) বিলুপ্তি ঘটানাে হয়েছে, সেখানে শুধুমাত্র বিধানসভায় সমস্ত বিল উত্থাপিত হয়। বিধানসভায় বিল পাস হলেই রাজ্যপালের সম্মতির জন্য প্রেরণ করা হয়।


সাধারণ বিল মূলত দু-ধরনের হয়। যথা— সরকারি বিল ও বেসরকারি বিল। রাজ্যের মন্ত্রীগণ যে বিল উত্থাপন করেন, তাকে বলা হয় সরকারি বিল এবং সাধারণ সদস্যরা যে বিল উত্থাপন করেন, তাকে বলা হয় বেসরকারি বিল। বেসরকারি বিল উত্থাপনের ১ মাস আগে নােটিশ দিতে হয়।


রাজ্য আইনসভায় একটি বিল আইনে পরিণত করার জন্য ৭টি পর্যায়ের কথা বলা হয়েছে। এই ৭টি পর্যায় নিম্নে আলােচনা করা হল


[1] প্রথম পর্যায়: প্রথম পর্যায়ে রয়েছে বিল উত্থাপন এবং বিলের প্রথম পাঠ। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিধানসভায় কোনাে সাধারণ বিল উত্থাপন করতে হলে বিলের উত্থাপককে সংশ্লিষ্ট কক্ষে স্পিকারের কাছে লিখিত নােটিশ দিয়ে সভার অনুমতি নিয়ে বিল উত্থাপন করতে হয়। এই পর্যায়ে শুধুমাত্র বিলের Title বা শিরােনামটাই পাঠ করা হয়। এই পর্যায়ে কোনােপ্রকার আলােচনা বা বিতর্ক হয় না। নিয়ম অনুসারে বিলটি উত্থাপিত হলে জনগণের অবগতির জন্য বিলটিকে সরকারি গেজেটে প্রকাশ করা হয়। এই পর্যায়ে বিলের উপর কোনাে আলােচনা হয় না। এটি হল বিলের প্রথম পাঠ। রাজ্যপালের অনুমতিক্রমে পূর্বেই বিলটি যদি সরকারি গেজেটে প্রকাশিত হয়ে থাকে তবে বিলটির উত্থাপনের জন্য উত্থাপককে আর কক্ষের অনুমতি চাইতে হয় না।


[2] দ্বিতীয় পর্যায়: বিল উত্থাপনের কয়েক দিন পর বিলের দ্বিতীয় পাঠ শুরু হয়। এই পর্যায়েই বিলের সাধারণ নীতিগুলি নিয়ে আলােচনা ও তর্ক বিতর্ক হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে উত্থাপক বিল সম্পর্কিত তিন ধরনের প্রস্তাব সভার নিকট উত্থাপন করেন। এই প্রস্তাব তিনটি হল

  • (a) বিলটি সভায় বিচারবিবেচনার জন্য গৃহীত হােক,
  • (b) বিলটিকে সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানাে হোক,
  • (c) বিলটি সম্বন্ধে জনমত যাচাই করার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হােক।


জনমত যাচাই করার জন্য বিলটিকে প্রচার করা হলে জনমত গ্রহণ করার পর বিলটিকে সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানাের ব্যবস্থা করা হয়। প্রথম প্রস্তাব অর্থাৎ বিলটিকে বিচারবিবেচনা করার প্রস্তাব গৃহীত হলে বিলের সাধারণ নীতিগুলি নিয়ে বিচারবিবেচনা ও বিতর্ক চলে। বিলের বিভিন্ন ধারার উপর আলােচনা চলে এবং প্রয়ােজনে সংশােধনও গৃহীত হয়।


[3] তৃতীয় পর্যায় :

  • কমিটি পর্যায়ে: কোন বিল কখন সিলেক্ট কমিটির নিকট প্রেরণের প্রস্তাব গৃহীত হয় তখন সংশ্লিষ্ট কক্ষের দায়িত্ব হল সিলেক্ট কমিটি গঠন করা। সভার অধ্যক্ষ সিলেক্ট কমিটির চেয়ারম্যান বা সভাপতিকে মনােনীত করেন। কমিটি পর্যায়ে বিলের বিভিন্ন ধারা ও খুঁটিনাটি বিষয়ে আলােচনা করে প্রয়ােজনে সংশােধনী ও মতামত-সহ কমিটি কক্ষের নিকট প্রতিবেদন আকারে পেশ করে।
  • প্রতিবেদন পর্যায়: প্রস্তাবিত বিলের উপর সিলেক্ট কমিটির রিপোর্ট বিধানসভায় পৌঁছানোর পর রিপাের্ট ও সংশােধিত বিলটিকে সরকারি গেজেটে প্রকাশ করা হয়। এই পর্যায়েও ভারপ্রাপ্ত সদস্য সভার নিকট যে-কোনাে একটি প্রস্তাব করতে পারেন যে- (a) কমিটি কর্তৃক প্রেরিত বিলের বিচারবিবেচনা করা হােক, (b) বিলটি পুনর্বিবেচনার জন্য কমিটির নিকট পুনরায় ফেরত পাঠানাে হােক এবং (c) জনমত যাচাই করার জন্য বিলটি প্রচার করা হােক।


[4] চতুর্থ পর্যায়: বিল পাসের চতুর্থ পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট বিলের প্রতিটি ধারা, উপধারা নিয়ে সবিস্তারে আলােচনা ও তর্ক বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। সভার যে-কোনাে সদস্য বিলটির উপরে যে-কোনাে সংশােধনী প্রস্তাব আনতে পারেন। অবশ্য সংশােধনী প্রস্তাব উত্থাপনের কমপক্ষে ১ দিন আগে সভায় বিজ্ঞপ্তি দিতে হয়। আলােচনা ও তর্ক বিতর্কের পর বিলের প্রতিটি ধারা ও উপধারা নিয়ে ভােটাভুটি হয়। সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর বিলের চতুর্থ পর্যায় এবং দ্বিতীয় পাঠের পরিসমাপ্তি ঘটে।


[5] পঞ্চম পর্যায়: পঞ্চম পর্যায়ে বিলের তৃতীয় পাঠ অনুষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয় পাঠ শেষ হওয়ার পরে যে-কোনাে দিন বিলের তৃতীয় পাঠের সূচনা করা হয়। এই পর্যায়ে বিল নিয়ে কোনােরকম আলোচনায় তর্ক বিতর্ক বা সংশােধনী প্রস্তাব আনা হয় না। বস্তুতপক্ষে বিলটি গ্রহণ করা হবে না বর্জন করা হবে সে নিয়ে এই পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য বিলটিকে সমর্থন করলে বিলটি গৃহীত হয়। অন্যদিকে সমর্থন না পাওয়া গেলে বিলটি খারিজ হয়ে যায়। এভাবে বিলটি বিধানসভায় গৃহীত হলে সে সম্পর্কে স্পিকার সার্টিফিকেট দিয়ে থাকেন।


[6] ষষ্ঠ পর্যায়: বিলের ষষ্ঠ পর্যায়ে অপর পক্ষের অনুমােদনের বিষয়গুলি আলােচিত হয়। প্রসঙ্গত বলা যায়, যেসব রাজ্যে বিধান পরিষদ আছে সেখানেই শুধু বিলের ষষ্ঠ পর্যায়ে বিলটি বিধান পরিষদের অনুমােদনের জন্য প্রেরিত হয়। বিধান পরিষদ সেক্ষেত্রে বিলে শুধুমাত্র সম্মতি দিতে পারে, সংশােধন করতে পারে, অসম্মতি জানাতে পারে অথবা বিলটি আটকে রাখতেও পারে। বিধানসভা কর্তৃক গৃহীত এ ধরনের কোনাে বিলকে বিধান পরিষদ প্রথম দফায় ৩ মাস, দ্বিতীয় দফায় ১ মাস, মােট ৪ মাস আটকে রাখতে পারে। এর বেশি কিছু করার ক্ষমতা বিধান। পরিষদের নেই। এমনকি বিল নিয়ে মতবিরােধ দেখা দিলে রাজ্য আইনসভার যুগ্ম অধিবেশন ডাকার ব্যবস্থাও সংবিধানে নেই।


[7] সপ্তম পর্যায়: সপ্তম পর্যায়ে বিলটি রাজ্য আইনসভায় গৃহীত হওয়ার পর রাজ্যপালের সম্মতির জন্য প্রেরিত হয়। রাজ্যপাল বিলে সম্মতি দিতে পারেন, সম্মতি প্রত্যাহার করতে পারেন, রাজ্য আইনসভার পুনর্বিবেচনার জন্য ফেরত পাঠাতে পারেন অথবা রাষ্ট্রপতির বিবেচনার জন্য সংরক্ষিত রাখতে পারেন। রাজ্যপাল কোনাে বিল আইনসভার পুনর্বিবেচনার জন্য ফেরত পাঠালে রাজ্য আইনসভা সংশােধন-সহ বা সংশােধন ব্যতীত সেই বিল পুনরায় অনুমোদন করলে রাজ্যপাল সম্মতি দিতে বাধ্য। রাজ্যপালের অনুমোদন ব্যতীত রাজ্য আইনসভা কর্তৃক গৃহীত কোনাে বিল আইনে পরিণত হতে পারে না।


এ প্রসঙ্গে আরও জেনে রাখা দরকার, মাননীয় রাজ্যপাল বিলে সম্মতি দিতে পারেন বা অসম্মতি জানাতে পারেন অথবা বিলটি পুনর্বিবেচনার জন্য ফেরত পাঠাতে পারেন এবং প্রয়ােজন মনে করলে তিনি নিজে বিলটিতে স্বাক্ষর না করে ভারতবর্ষের মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে বিলটির চূড়ান্ত অনুমােদনের জন্য প্রেরণ করতে পারেন। রাষ্ট্রপতি বিলটি স্বাক্ষর করতে বা ফেরত পাঠাতে পারেন। রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষর করলে বিলটি আইনে পরিণত হয় আর স্বাক্ষর না করলে বিলটি বাতিল বলে ঘােষিত হয়।