লোকসভা কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে রাজ্যসভা অপেক্ষা বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন?

ভূমিকা: ভারতের কেন্দ্রীয় আইনসভা বা পার্লামেন্ট সংসদ নামে পরিচিত। সংবিধানের ৭৯ নং ধারা অনুসারে রাষ্ট্রপতি এবং দুটি কক্ষ যথা রাজ্যসভা ও লোকসভা নিয়ে পার্লামেন্ট গঠিত হয়। পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষের নাম রাজ্যসভা (Council of States) এবং নিম্নকক্ষের নাম লােকসভা (House of the People)। ভারতীয় পার্লামেন্ট ব্রিটিশ পার্লামেন্ট এবং আমেরিকার আইনসভা কংগ্রেসের ধারা যৌথভাবে অনুসরণ করে গড়ে উঠেছে। ("The Indian Constitution has wonderfully adopted the Synthesis of the English Principle of Parliamentary Sovereignty and the American system of Judicial Supremacy.")


লোকসভার গঠন: ভারতীয় পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষের নাম হল লোকসভা। এই কক্ষের প্রতিনিধিগণ জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে দ্বারা নির্বাচিত হয় বলে এই কক্ষকে জনপ্রতিনিধি কক্ষ বলা হয়। লোকসভা সদস্য সংখ্যা সর্বাধিক ৫৫২ জন হতে পারে। বর্তমানে লোকসভার সদস্য সংখ্যা ৫৪৫ জন। লোকসভার সদস্যদের তিন ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। যথা— (a) অঙ্গরাজ্যে প্রতিনিধি। অঙ্গরাজ্যের প্রতিনিধি সর্বাধিক ৫৩০ জন হতে পারে। (b) কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের প্রতিনিধি। (c) কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের প্রতিনিধি সংখ্যা সর্বাধিক ২০ জন হতে পারে এবং (d) রাষ্ট্রপতি কর্তৃক মনােনীত প্রতিনিধি। লোকসভায় রাষ্ট্রপতি ২ জন ইঙ্গ-ভারতীয় লোকসভার প্রতিনিধি মনােনীত করতে পারেন।


রাজ্যসভার তুলনায় লোকসভার ক্ষমতা

(1) মন্ত্রীসভা কেবলমাত্র লোকসভার কাছে দায়িত্বশীল: ভারতের সংসদীয় বা মন্ত্রীসভা-চালিত শাসনব্যবস্থা বজায় রয়েছে। এই কারণেই এই শাসনব্যবস্থায় মন্ত্রীসভার দায়িত্বশীলতার নীতি স্বীকৃতি পেয়েছে। সংবিধানের ৭৫ (৩) নং ধারা অনুসারে মন্ত্রীসভা কেবলমাত্র লোকসভার কাছেই দায়িত্বশীল থাকে। লোকসভার হাতে ন্যস্ত থাকে মন্ত্রীসভার গঠন ও অপসারণ পদ্ধতি সমূহ। এক্ষেত্রে রাজ্যসভা কোনাে ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেনি। লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়ে অনাস্থা জ্ঞাপন করলে মন্ত্রিসভা কে পদত্যাগ করতে হয়। কিন্তু রাজ্যসভা অনাথা জ্ঞাপন করলে মন্ত্রীসভাকে পদত্যাগ করতে হয় না। এখানেই লোকসভা রাজ্যসভা থেকে অধিক ক্ষমতা ভোগ করে থাকে।


(2) অর্থ সংক্রান্ত ক্ষেত্রে লোকসভা একক প্রাধান্য: সাধারণ বিল পাসের ক্ষেত্রে রাজ্যসভা ও লোকসভা সমান ক্ষমতার অধিকারী হলেও, অর্থ বিলের ব্যাপারে কিন্তু লােকসভার হাতেই যাবতীয় ক্ষমতা ন্যস্ত রয়েছে। সংবিধান অনুসারে অর্থবিল বা অর্থবিলের সংশােধন রাজ্যসভায় উত্থাপন করা যায় না। এই কারণেই কোনাে বিল অর্থ বিল কি না এ বিষয়ে লোকসভার স্পিকারের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য হয়। এ ছাড়া ব্যয়ের দাবি মঞ্জুর, বিনিয়োগ বিল পাসের ক্ষেত্রে লোকসভার ক্ষমতা চরম ও চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হয়।


(3) সরকারের ব্যয়মঞ্জুরি দাবির ক্ষেত্রে লোকসভার ক্ষমতা: রাজ্যসভায় বার্ষিক আর্থিক বিবরণী নিয়ে কোনরূপ আলােচনা হয় না। অপরদিকে সরকারের ব্যয় মঞ্জুরি দাবি নিয়ে ভােট সম্পর্কিত আলােচনা শুধুমাত্র লোকসভায় হয়ে থাকে। সাধারণ আলােচনা শেষ হওয়ার পর লোকসভার বিশেষ বিশেষ খাতে ব্যয় মঞ্জুরি দাবির আকারে সম্ভাব্য ব্যয়ের হিসাব পেশ করা হয় এবং তারপর প্রতিটি খাতে ভােট নেওয়া হয়ে থাকে [ অনুচ্ছেদ ১১৩ (২)]। এক্ষেত্রেও লোকসভার বিশেষ ক্ষমতা ভোগ করে থাকে।


(4) লোকসভা জরুরি অবস্থার ক্ষেত্রে তার ক্ষমতা প্রয়োগ করে থাকে: পূর্বে জরুরি অবস্থা সংক্রান্ত ক্ষেত্রে লোকসভা ও রাজ্যসভা সমান ক্ষমতা ভোগ করে থাকত, কিন্তু ৪৪ তম সংবিধান-সংশােধনী আইন অনুসারে লোকসভা জরুরি অবস্থা প্রত্যাহারের উদ্দেশ্যে কোনাে প্রস্তাব গ্রহণ করলে রাষ্ট্রপতি জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার করতে বাধ্য থাকেন। রাষ্ট্রপতি ও স্পিকার দুজনেই লোকসভার এক-দশমাংশ সদস্যের অনুরােধক্রমে জরুরি অবস্থা সংক্রান্ত বিষয় আলােচনা করতে পারেন। এক্ষেত্রে রাজ্যসভায় কোনাে ক্ষমতা প্রদান করা হয়নি।


সমালােচনা: লোকসভার একক প্রাধান্যের ক্ষেত্রেও কিছু ত্রূটি লক্ষ করা যায়। কারণ, আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে লােকসভা বিশেষ ক্ষমতা ভোগ করতে পারে না। এ ছাড়াও বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর প্রাধান্য বৃদ্ধির ফলে লোকসভার ক্ষমতা অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে।


মূল্যায়ন: পরিশেষে বলা যায়, রাজনৈতিক দিক থেকে বিচার করলে রাজ্যসভার তুলনায় লোকসভা মর্যাদা অনেক বেশি। লোকসভায় বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উত্থাপিত হয় ও আলােচিত হয়। লোকসভা নির্বাচনকে ঘিরে যে রাজনৈতিক তৎপরতা, উদ্যোগ ও উৎসাহ পরিলক্ষিত হয়, রাজ্যসভার নির্বাচনকে ঘিরে তা লক্ষ করা যায় না। জনসাধারণের কাছে রাজ্যসভার তুলনায় লোকসভা আকর্ষণ বেশি। বেশিরভাগ রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীবৃন্দ রাজ্যসভার তুলনায় লোকসভায় নির্বাচিত হওয়ার জন্য বেশি আগ্রহ ও উৎসাহ দেখান। কারণ, লোকসভা রাজ্যসভার তুলনায় অনেক বেশি প্রভাবশালী ও ক্ষমতাশালী কক্ষ।