ভারতীয় সংসদে বিরােধীদলের ভূমিকা আলােচনা করাে।

ভারতীয় সংসদে বিরােধীদলের ভূমিকা

গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় আইনসভা বা পার্লামেন্টের অভ্যন্তরে বিরােধীদলের অস্তিত্ব অপরিহার্য। বিরোধী দল হল গণতন্ত্রের অন্যতম স্তম্ভ। বিরােধীদল ব্যতিরেকে সংসদীয় গণতন্ত্র অর্থহীন হয়ে পড়ে। সংসদীয় গণতন্ত্রের পীঠস্থান বা মাতৃভূমি হল ইংল্যান্ড। ইংল্যান্ডের শাসন ব্যবস্থায় বিরোধী দলের অনুকরণে ভারতে বিরােধীদল গড়ে উঠেছে। ইংল্যান্ডে একটি প্রবাদবাক্য চালু আছে ওই দেশে সরকারকে বলা হয় রাজা-রানির সরকার বা বিরােধীদলকে বলা হয় রাজা-রানির বিরােধীদল (Her Majesty's Opposition is as important as Her Majesty's Government)। ভারতের সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় বিরোধী দলের ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।


সংসদে বিরােধীদলের ধারণা


সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দল সরকার গঠন করে। এই দলকে বলা হয় ক্ষমতাসীন দল (Party in Position)। এই সংখ্যাগরিষ্ঠ দল ছাড়া আইনসভায় অন্যান্য যে দলগুলি থাকে, সেগুলির মধ্যে সর্ববৃহৎ দলটি বিরোধীদলের (Party in Opposition) মর্যাদা পায়। একটি শক্তিশালী বিরােধীদলই সরকার জনবিরোধী নীতি পরিহার, গণতান্ত্রিক মূল্যবােধের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ এবং স্বেচ্ছাচারী নীতি বর্জন ও সংযত করতে বাধ্য করতে পারে। সুতরাং শক্তিশালী এবং সংহত শাসকদলের মতাে সদাজাগ্রত ও সুসংগঠিত বিরােধীদলসমূহের মাধ্যমেই গণতন্ত্রের ভিত্তি সুদৃঢ় ও প্রশস্ত হয় এবং তার সঙ্গেই বিরােধীদলগুলিকে গণতন্ত্রের অপরিহার্য শর্তরূপে চিহ্নিত করা হয়।


সংসদে বিরোধী দলের কার্যকলাপ


ভারতীয় সংসদে বিরোধী রাজনৈতিক দল বহু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এগুলি নিম্নে আলােচনা করা হল―


[1] সরকার কঠোর সমালোচক: বিরােধীদলকে সর্বদা সরকার গঠনের জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। বিরোধী দলের মুখ্য লক্ষ্য সরকারের বিরােধিতা করা। কিন্তু বিরােধিতা বলতে বিরােধিতা কিংবা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করাকে বােঝায় না। বিরোধী দলের সমালােচনা আনুগত্য ভিত্তিক, গঠনমূলক এবং দায়িত্বশীল। বিরােধীদলকে সংবিধানের মৌলিক নীতির প্রতি আনুগত্য জ্ঞাপন করতে হয়। দায়িত্বশীল বিরোধী দল সরকারি দলের স্বৈরাচারী প্রবণতা রােধ করতে সাহায্য করে। এই কারণেই এরূপ বিরোধী দল সরকারের শ্রদ্ধা এবং আস্থা সহজেই অর্জন করতে পারে। পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা, আন্তর্জাতিক সমস্যা সম্পর্কিত ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলের নেতাদের সঙ্গে পরামর্শ করে থাকেন। জাতীয় সংকটের সময় সরকার এবং বিরােধী পক্ষের সহযােগিতা প্রয়ােজন হয়। দায়িত্ববােধের মাত্রা বিচার করে নির্বাচকমণ্ডলী তাদের হাতে সরকার গঠনের দায়িত্ব ন্যস্ত করতে পারে। এই কারণেই বিরােধীদলের সদর্থক ভূমিকা পালন গণতন্ত্রের প্রধান স্তম্ভ বলে বিবেচিত হয়।


[2] বিকল্প সরকার গঠন: বিরোধীদলকে বলা হয় বিকল্প সরকার। শাসকদল কোনাে কারণে ক্ষমতাচ্যুত হলে বিকল্প নীতির ভিত্তিতে সরকার গঠনের জন্য বিরোধী দল প্রস্তুত থাকে। এই কারণেই সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় বিরোধী দলকে ছায়া সরকার (Shadow Government) বলা হয়ে থাকে। যদিও ভারতবর্ষে এই ঐতিহ্য এখনও পুরােপুরি গড়ে ওঠেনি, তারা এখনও বিকল্প সরকার গঠন করে উঠতে পারেনি। বিরোধী দলের প্রধান লক্ষ্য হল সরকারের প্রবল সমালােচনা করে নির্বাচনের মাধ্যমে নিজেদের অনুকূলে জনমত গড়ে তোলা। মূলত, ভারতবর্ষে বিরােধী রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারি ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করে থাকে।


[3] সংসদীয় কার্যপদ্ধতি পরিচালনায় সাহায্য: বিরোধীদলকে প্রধান কাজ শুধুমাত্র সরকারের সমালােচনা করা নয়। বিরােধীদল মূলত গঠনমূলক ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে সংসদকে পরিচালনা করে থাকে বলেই বিরোধী দল সরকারের সাহায্য ও সহযােগিতা করতে পারে। বিরােধীদল সর্বদাই সচেতন থাকে যে, শাসক দল একটি সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি নিয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে কি না, যদি হয় তাহলে সরকারের প্রধান কর্তব্য হল ওই কর্মসূচিকে রূপায়ণ করা। সুতরাং অর্থহীন সমালোচনা এবং বাধাদানের মাধ্যমে সময় নষ্ট না করাই দায়িত্বশীল বিরােধীদলের কর্তব্য। বিরােধীদল সবসময় সচেতন থাকে যেন সংসদীয় মূল্যবােধকে সঠিকভাবে মর্যাদা প্রদান করা হয়, তা না হলে সংসদ বিতর্ক ও আলাপ-আলােচনায় জড়িয়ে পড়তে পারে। তবে, এক্ষেত্রে সরকারেরও বিরােধীদলের সমালােচনা শােনার মানসিকতা থাকতে হবে, অন্যথায় গণতন্ত্র কলুষিত হয়ে পড়তে পারে।


[4] সরকার স্বৈরাচারিতা রােধ ও ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষা: সরকারের স্বৈরাচারিতা রােধ ও ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষায় বিরােধীদল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। বিরােধীদলকে ব্যক্তিস্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের অন্যতম স্তম্ভ বলে মনে করা হয়। বিরােধীদল সরকারের সমালােচনার মাধ্যমে নাগরিকদের স্বাধীনতা এবং স্বাধীন মতপ্রকাশের প্রতীকে পরিণত হয়েছে। বলাবাহুল্য, বিরােধীদল আসলে সরকারের স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতাকে রােধ করার চেষ্টা করে। এই কারণেই বিরােধীদলের উপর কোনরূপ বাধানিষেধ আরােপ করাকে গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ বলে মনে করা হয়।


[5] অবিবেচনাপ্রসূত ব্যবস্থা প্রতিরোধ করে: গঠনমূলক সমালােচনার মাধ্যমে বিরোধী দল সরকার কোনরূপ অবিবেচনাপ্রসূত বিল বা সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনায় বাধ্য করতে পারে। অর্থাৎ আর্থিক বিষয়ে সংসদে বিরােধীদলই একমাত্র সমালােচক। বিরােধীদল লোকসভার সকল সিলেক্ট কমিটিতে প্রতিনিধিত্ব করে থাকে। যেমন—সাংবিধানিক রীতিনীতি অনুসারে সাধারণত বিরােধীদলের কোনাে নেতাকে লোকসভার অধ্যক্ষ সরকারি গাণিতিক কমিটির চেয়ারম্যানের পদে নিয়ােগ করতে পারেন।


[6] মন্ত্রিসভায় দায়িত্বশীলতা সৃষ্টি করে: বিরােধীদল সুচিন্তিত ভাবে সকল সরকারি প্রস্তাব ও নীতির বিষয়ে পর্যালোচনা, সমালােচনা ও অনুসন্ধানকার্য পরিচালনা করে থাকে। সরকারের জনবিরােধী নীতির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ, সরকারের নীতি পরিবর্তনের জন্য চাপ সৃষ্টি, প্রশাসনের ব্যর্থতা, দুর্নীতি ও দুর্বলতার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা বিরােধীদলের অবশ্যই কর্তব্য। বিরােধীদল সংসদের অভ্যন্তরে বিতর্ক ও প্রশ্নোত্তর এবং বাইরে দলীয় সংগঠন, সভা-সমিতি, রেডিয়াে, সংবাদপত্র, টেলিভিশন ইত্যাদির মাধ্যমে নিরন্তর প্রচারকার্য চালায়। এই পদ্ধতির মাধ্যমে বিরােধীদল সরকারের ঔদাসীন্য প্রতিরােধ এবং জনমতের প্রতি সরকারের সংবেদনশীলতা সৃষ্টির চেষ্টা করে।


সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা পর্যালোচনা


[1] একক দল ব্যবস্থা ও বিরোধী দল: শক্তিশালী বিরোধী দলের অস্তিত্ব ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত নগণ্য ছিল। কেননা একমাত্র প্রভুত্বকারী দল হিসেবে কংগ্রেসের একক প্রাধান্য বিরােধী রাজনৈতিক দলের ভূমিকা পালনের ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করেছে। অবশ্য পরে কংগ্রেসের ভাঙনের ফলে বিরোধী দলের শক্তি সঞ্চারিত হয়েছে। ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় জরুরি অবস্থা কংগ্রেস দল জারি করেছিল বলেই জনতা পার্টি সারা ভারত জুড়ে প্রতিবাদী আন্দোলন গড়ে তােলে। এরই ফলশ্রুতি হল ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে প্রধান বিরােধীদল হিসেবে জনতা পার্টির সরকার গঠন।


[2] বহুধাবিভক্ত বিরােধীদল ও প্রধান বিরােধীদল: সংসদে একটি শক্তিশালী বিরােধীদলের পাশাপাশি একাধিক আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল দেখা যায়, যারা অনেকসময় সরকারি পক্ষের বিরােধিতা করে বিরােধী আসনে বসেন। ওই সময় দল প্রধান বিরােধীদলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সরকারকে বিড়ম্বনায় ফেলার চেষ্টা করে। আবার ওই সমস্ত আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলিকে নিজেদের স্বার্থে বিরােধী শিবির ত্যাগ করে সরকার পক্ষে যােগদান করতে হয়।


[3] জোট রাজনীতি ও বিরোধী দল: ভারতে জোট রাজনীতি বা কোয়ালিশন গঠনের মাধ্যমে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয় এবং সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেই বিরােধীদল সরকার গঠন করতে পারে। যে কোয়ালিশন বা জোট সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ হয় তারাই বিরােধী আসন গ্রহণ করে থাকে। অবশ্য অনেকক্ষেত্রে নেতৃত্ব স্থানীয়দের মধ্যে মতাদর্শগত চিন্তাভাবনা ও কর্মসূচি ভিন্ন হওয়ায় তাদের জোট অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়ে, যা ভারতীয় রাজনীতিতে বিরােধীদলের কার্যকরী ভূমিকা পালনের ক্ষেত্রে অনেকসময় বাধাপ্রাপ্ত হয়।


সমালােচনা: ভারতীয় পার্লামেন্ট সুসংহত কোনাে বিরােধীদল নেই। ভারতের বিরােধীদলগুলি রাজনৈতিক দিক থেকে বামপন্থী, দক্ষিণপন্থী এবং মধ্যপন্থী বিভক্ত। ভারতের বিরােধীদলগুলি নানা কারণে দুর্বল, ভারতের বিরােধীদলগুলি সংসদীয় রাজনীতিতে যথার্থ বিরােধীদলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেনি। তবে বিরোধী দলের ভূমিকা প্রভূত পরিমাণে শাসকদলের উপর নির্ভরশীল। শাসকদল সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে যদি বিরােধীদলের কণ্ঠরােধ করার নীতি গ্রহণ করে, তাহলে বিরােধীদলের সদস্যদের পক্ষে কোনাে মতামত প্রকাশ করা সম্ভব হয় না। যেমন ১৯৫২-১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বিরােধীদলগুলি কংগ্রেসের কাছে বারংবার পরাজয়ের ফলে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। যদিও দেখা গেছে, ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে সাধারণ নির্বাচনে বিজেপি এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পেরেছে এবং নরেন্দ্র দামােদরদাস মোদী প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন হতে পেরেছেন। এই অবস্থার পরিবর্তনের পর দেখা গেছে যে, শক্তিশালী কংগ্রেস দল কিন্তু একটি দুর্বল রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়েছে।


পরিশেষে বলা যায় যে, ভারতে বিরােধীদলের ইতিহাস সর্বাংশে হতাশাজনক নয়। বিরােধীদল বিভিন্ন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা এবং আইনসভায় সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রচলিত বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করে, শাসকদলের ত্রূটিবিচ্যুতিগুলিকে এমনভাবে প্রকট করে তােলে যাতে পরবর্তী নির্বাচনে শাসকদলের জনসমর্থন হ্রাস পায় এবং বিরােধীদলের পক্ষে জনসমর্থন বৃদ্ধি পায়। অতীতে বহু বিরোধী দলনেতা সংসদের আলােচনায় আলােড়ন তুলেছেন, সংসদকে আন্দোলিত করেছেন তাদের দক্ষতা এবং বক্তব্যের মাধ্যমে। তারা সংসদের তথা লোকসভার মর্যাদা বৃদ্ধি করেছেন। যেমন— অটলবিহারী বাজপেয়ী, বলরাম জাখর এবং লালকৃয় আদবানী, প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সী, জ্যোতির্ময় বসু, গুরুদাস দাসগুপ্ত, বর্তমানে সুগত বসু, সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, সইফুদ্দিন চৌধুরি প্রমুখদের কথা উল্লেখ করা যায়। সাংসদ হিসেবে এনাদের ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য।