সুপ্রিমকোর্টের মর্যাদা | সুপ্রিমকোর্টের ভূমিকার মূল্যায়ন | ভারতীয় সামাজিক প্রগতিতে সুপ্রিমকোর্টের ভূমিকা | ভারতীয় সংবিধানের অভিভাবক ও ব্যাখ্যা কর্তা হিসেবে সুপ্রিমকোর্টের ভূমিকা

ভারতীয় সামাজিক প্রগতিতে সুপ্রিমকোর্টের ভূমিকা

ভূমিকা: যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত হিসেবে ভারতীয় সুপ্রিমকোর্টের উপর যে দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে তা পর্যালোচনা করে আমরা বলতে পারি যে, বিভিন্ন রাজনৈতিক পরিমণ্ডলকে উপেক্ষা করে যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত হিসেবে সুপ্রিম কোর্ট তার যথাযথ ভূমিকা পালনে নজির সৃষ্টি করে। কোন স্বামী আইনের ভাষায়, পৃথিবীর অন্য কোনাে অঞ্চলের সুপ্রিম কোর্ট থেকে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট অনেক বেশি শক্তিশালী ("The Supreme Court in the Indian Union has more powers than any Supreme Court in any Part of the World.”)। এই কারণে যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত হিসেবে, সর্বোচ্চ আপিল আদালত হিসেবে, সংবিধানের অভিভাবক ও চূড়ান্ত ব্যাখ্যাকর্তা হিসেবে, নাগরিকের মৌলিক অধিকারের রক্ষাকর্তা এবং রাষ্ট্রপতির পরামর্শদাতা হিসেবে ভারতের সুপ্রিমকোর্টের ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। অধ্যাপক জোহারি মন্তব্য করেছেন, আমাদের প্রতিষ্ঠাতারা ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন যে, সংবিধানের প্রকৃত অভিভাবকের মতো সুপ্রিম কোর্টের আচরণ উচিত (“What our Founding Fathers really desired is that the Supreme Court should behave like true guardian of the Constitution.")


সুপ্রিমকোর্টের মর্যাদা


(1) সংবিধানের চূড়ান্ত ব্যাখ্যা কারক হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের ভূমিকা: সংবিধানের অভিভাবক ও ব্যাখ্যাকর্তা হিসেবে সুপ্রিমকোর্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। ভারতীয় সংবিধানের যে-কোনাে অংশের চূড়ান্ত ব্যাখ্যা দেওয়ার ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের আছে। সুপ্রিম কোর্ট আইনসভা কর্তৃক প্রণীত আইন, রাষ্ট্রপতি এবং রাজ্যপালের আদেশ ইত্যাদি সংবিধানবিরােধী কি না তা পর্যালােচনা করে দেখে। এ প্রসঙ্গে এ কে গোপালন বনাম মাদ্রাজ রাজ্য (১৯৫০ খ্রি.), গােলকনাথ বনাম পাঞ্জাব রাজ্য (১৯৬৭ খ্রি.), কেশবানন্দ ভারতী বনাম কেরল রাজ্য (১৯৭৩ খ্রি.) প্রভৃতি মামলাগুলিতে সুপ্রিম কোর্টের রায় দান বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য।


(2) যুক্তরাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের ভূমিকা: সুপ্রিম কোর্ট যুক্তরাষ্ট্রের অখণ্ড বিচারব্যবস্থায় ক্রমােচ্চ স্তরবিন্যাসের শীর্ষে ভারতীয় অবস্থিত। এটি একদিকে দেশের সর্বোচ্চ আপিল আদালত, অন্যদিকে ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় সর্বোচ্চ যুক্তরাষ্ট্রীয় বিচারালয়। দেশের সর্বোচ্চ যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত হিসেবে সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্র এবং রাজ্য এবং রাজ্য বনাম রাজ্যের যুক্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্ককে রক্ষা করে। আবার যে লিখিত সংবিধানের মাধ্যমে এই যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামাে প্রতিষ্ঠিত এবং কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টন করা আছে, সেই সংবিধানের রক্ষাকর্তা ও চরম ব্যাখ্যাকর্তা হল সুপ্রিমকোর্ট। ভারতীয় নাগরিকদের সংবিধান-স্বীকৃত মৌলিক অধিকারের রক্ষণাবেক্ষণ ও সুপ্রিম কোর্ট করে থাকে। সংবিধানের ভাষায় বলা যায়, ("The state shall not make any law which takes away or abridges the rights conferred by this part and any law made in contravention of this clause, to the extend of the contravention be avoid Art 13(2).”)


(3) সর্বোচ্চ আপিল আদালত হিসেবে সুপ্রিমকোর্টের ভূমিকা: সর্বোচ্চ আপিল আদালত হিসেবে পরিচিত সুপ্রিম কোর্টের ভূমিকা অন্য যে-কোনাে আদালতের থেকে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। সংবিধানের ব্যাখ্যা সংক্রান্ত কোনাে গুরুত্বপূর্ণ আইনগত প্রশ্নের ক্ষেত্রে মহাধর্মাধিকরণ (হাইকোর্ট) থেকে প্রধান ধর্মাধিকরণে রে (সুপ্রিম কোর্ট) আপিল করা যায়। দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা সংক্রান্ত ব্যাপারে সুপ্রিমকোর্টের নিকট আপিল করা যায়। সংবিধানের ১৩৬ নং ধারা অনুযায়ী সামরিক আদালত ছাড়া ভারতের যে-কোনাে আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিমকোর্টে আপিল করা যায়। আপিল আদালত হিসেবে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট যে ক্ষমতা ভােগ করে, তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট ভােগ করে না।


(4) রাষ্ট্রপতির আইনগত পরামর্শদাতা হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের ভূমিকা: জনসাধারণের স্বার্থ জড়িত এমন কোনাে আইন বা তথ্য সম্পর্কিত জটিল প্রশ্নের উদ্ভব ঘটলে বা উদ্ভবের সম্ভাবনা দেখা দিলে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে রাষ্ট্রপতি সুপ্রিমকোর্টের পরামর্শ চাইতে পারেন এবং সুপ্রিমকোর্টও সংবিধানের ১৪৩ (১) এবং ১৪৩ (২) নং ধারানুযায়ী রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দিয়ে জনস্বার্থের সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে।


(5) সংবিধানের অভিভাবক ও রক্ষাকবচ হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের ভূমিকা: ভারতীয় সংবিধান ভারতবাসীর কাছে অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। সেই সংবিধানের অভিভাবকের ন্যায় সযত্নে রক্ষা করার দায়িত্বভার যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত হিসেবে পরিচিত সুপ্রিম কোর্টে উপর ন্যস্ত করা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের রক্ষাকবচ হিসেবে যে বিষয়গুলিতে সর্বদা দৃষ্টি রেখে চলে সেই বিষয়গুলি হল নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলি কতটা সুরক্ষিত, আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ সংবিধান অনুযায়ী তাদের দায়িত্ব পালন করছে কি না প্রভৃতি।


(6) সুপ্রিম কোর্টের বিচার বিভাগীয় পর্যালােচনার ক্ষমতা: সুপ্রিম কোর্ট যে-সমস্ত বিষয়গুলি বিচার করে, সেগুলি হল পার্লামেন্ট-প্রণীত আইন সঠিক পদ্ধতিতে পরিচালিত হচ্ছে কিনা, রাষ্ট্রপতি এবং রাজ্যপালগণের আদেশ সংবিধান বিরোধী কি না ইত্যাদি আর যদি পার্লামেন্ট-প্রণীত আইন, রাষ্ট্রপতি এবং রাজ্যপাল গণের আদেশ সংবিধানবিরােধী বলে প্রমাণিত হয় তাহলে সুপ্রিম কোর্ট তা অবৈধ বলে ঘােষণা করতে পারে। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের এই ধরনের বিশেষ ক্ষমতা বিচারবিভাগীয় পর্যালােচনার ক্ষমতা (Power of Judicial Review) বলে অভিহিত করা হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার যে, সুপ্রিমকোর্ট শুধুমাত্র দেখে আইন নির্দিষ্ট পদ্ধতি সঠিকভাবে মানা হচ্ছে কি না। সুপ্রিমকোর্ট কখনােই আইনের যথাবিহিত পদ্ধতি অনুসারে বিচারকার্যের কোনাে ক্ষমতা প্রয়ােগ করতে পারে না।


(7) সামাজিক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণে সুপ্রিমকোর্টের ভূমিকা: সমাজের অনেক কুপ্রথা, অন্যায়, অত্যাচারিত, নিপীড়িত ও শোষিত মানুষের হয়ে কাজ করে সুপ্রিমকোর্ট নিজের অস্তিত্বকে তুলে ধরতে সমর্থ হয়েছে। সুপ্রিমকোর্ট বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মামলায় রায় প্রদান করে অনেক সামাজিক ব্যাধি থেকে ভারতবাসীকে রক্ষা করতে সচেষ্ট হয়েছে। অর্থাৎ সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবেও ভারতীয় সুপ্রিমকোর্টের ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা আইনের ১৭(ক) অনুচ্ছেদ বাতিল করা, ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে বধূহত্যার দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের চরম শাস্তির সপক্ষে রায়দান, ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে পরিবেশ সংরক্ষণ সংক্রান্ত নির্দেশ, ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের দুর্নীতির তদন্তে সি বি আইকে স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষমতা প্রদান প্রভৃতি রায় বা সিদ্ধান্ত সমাজ পরিবর্তনে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছে।


সুপ্রিমকোর্টের ভূমিকার সমালোচনা


সুপ্রিমকোর্টের ভূমিকা বা মর্যাদা একেবারেই সমালােচনার উর্ধ্বে নয়। সুপ্রিমকোর্ট পার্লামেন্ট দ্বারা খানিকটা নিয়ন্ত্রিত এবং মার্কিন সুপ্রিমকোর্টের ক্ষমতা থেকে ভারতীয় সুপ্রিমকোর্টের ক্ষমতা কিছুটা হলেও কম। এই দুটি নিম্নে আলােচনা করা হল一


(1) পার্লামেন্টের নিয়ন্ত্রণের কারণে সংবিধানের অভিভাবক ও ব্যাখ্যা কর্তা হিসেবে পরিচিত সুপ্রিমকোর্টের ক্ষমতা বেশি কি না তা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন দেখা যায়, কারণ— ভারতীয় সংবিধানের নমনীয় চরিত্রের জন্য অনেকসময় দেখা যায় সুপ্রিমকোর্ট প্রদত্ত রায়কে অতিক্রম করার উদ্দেশ্যে পার্লামেন্ট সংবিধান-সংশােধনের পথ গ্রহণ করে। যেমন গােলােকনাথ মামলা এবং কেশবানন্দ ভারতী মামলায় সুপ্রিমকোর্ট জানায় যে, পার্লামেন্ট সংবিধানের মূল কাঠামাে ছাড়া বাকি সব অংশই সংশােধন করতে পারে।


(2) মার্কিন সুপ্রিমকোর্টের ক্ষমতা ভারতীয় সুপ্রিমকোর্টের ক্ষমতা থেকে কিছু ক্ষেত্রে ব্যাপক। যেমন— মার্কিন সুপ্রিমকোর্ট কোনাে আইনের বৈধতা বিচারে কিংবা সংবিধান অনুযায়ী প্রণীত হচ্ছে। কি না তার বিচার করে আইনটিকে বৈধ বা অবৈধ ঘােষণা করে থাকে। অপরদিকে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট পার্লামেন্টের কোনাে আইনকে তখনই অবৈধ বলে ঘােষণা করতে পারে, যদি উক্ত আইনটি সংবিধানের কোনাে ধারা বা অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন করে। এর ফলে সুপ্রিমকোর্টের মর্যাদা যথেষ্ট পরিমাণে ক্ষুগ্ন হয়ে থাকে।


মূল্যায়ন : ভারতীয় সুপ্রিমকোর্টের ভূমিকা পর্যালোচনা করলে বলা যায় যে, সুপ্রিমকোর্ট তার অস্তিত্বকে সঠিকভাবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। রাজনীতি পরিব্যাপ্ত কলুষিত সমাজ তথা রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে ভারতবাসীকে মুক্ত করে এক পরিচ্ছন্ন রাষ্ট্রব্যবস্থা উপহার দেওয়াই সুপ্রিমকোর্টের কাছে এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেন ২০০৩ খ্রিস্টাব্দে সুপ্রিমকোর্ট এক নির্দেশে ক্যাপিটেশন ফি নেওয়া বন্ধের নির্দেশ দেন তা ছাড়া ২০০৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতব্যাপী জুনিয়ার ডাক্তারদের যে ধর্মঘট সারাদেশের স্বাস্থ্য পরিসেবাকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল, তা সুপ্রিমকোর্টের হস্তক্ষেপের ফলে স্তিমিত হয়ে পড়ে। এইভাবে সুপ্রিমকোর্ট তার ভূমিকা পালনের মধ্য দিয়ে তার মর্যাদা এবং ঐতিহ্যকে ভারতবাসীর কাছে তুলে ধরতে সমর্থ হয়েছে। এককথায় ভারতীয় সুপ্রিমকোর্ট শুধু সংবিধানের অভিভাবক ও ব্যাখ্যাকর্তাই নয়, সুপ্রিমকোর্ট গণতন্ত্রের রক্ষাকর্তা হিসেবেও তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।


বিধানসভার মূল কাজ | পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার গঠন, ক্ষমতা ও কার্যাবলি


পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার অধ্যক্ষের ভূমিকার পর্যালােচনা করো।


পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার সীমাবদ্ধতাগুলি উল্লেখ করাে।


ভারতের সংসদীয় কার্যপদ্ধতির গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি দিক বিস্তারিতভাবে আলােচনা করাে।


ভারতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্ব বলতে কী বােঝায়?


জিরাে আওয়ার ও অনাস্থা প্রস্তাব সম্পর্কে আলােচনা করাে।


ছাঁটাই প্রস্তাব বলতে কী বােঝায়? বিভিন্ন ধরনের ছাঁটাই প্রস্তাব সম্পর্কে আলােচনা করাে।


মুলতুবি প্রস্তাব ও দৃষ্টি আকর্ষণী প্রস্তাব সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও।


ভারতের বিচারব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যসমূহ আলােচনা করো।


ভারতের সুপ্রিমকোর্টের গঠন ও কার্যাবলি ব্যাখ্যা করাে।


সুপ্রিম কোর্টের প্রধান এলাকাগুলি কী কী? সুপ্রিমকোর্টের মূল এলাকাভুক্ত ও আপিল এলাকাভুক্ত ক্ষমতাগুলি আলােচনা করাে।


সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শদান এলাকা বলতে কী বােঝাে? ভারতীয় সামাজিক প্রগতিতে সুপ্রিমকোর্টের ভূমিকা বিষয়ে একটি টীকা লেখো।