ছাঁটাই প্রস্তাব বলতে কী বােঝায়? বিভিন্ন ধরনের ছাঁটাই প্রস্তাব সম্পর্কে আলােচনা করাে।

ছাঁটাই প্রস্তাব

পার্লামেন্ট কিংবা রাজ্য বিধানমণ্ডলীর অর্থ সংক্রান্ত কার্য পদ্ধতির বিশেষত বাজেট অর্থাৎ বার্ষিক আয় ব্যয় সংক্রান্ত প্রস্তাব পাসের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় রয়েছে। এই পর্যায়গুলির প্রথমটি হল বাজেট উত্থাপন যা অর্থমন্ত্রী অনুমােদনের জন্য লোকসভায় পেশ করেন এবং তার উপর বক্তৃতা দেন। দ্বিতীয় পর্যায়ে বাজেটের উপর আলােচনা করা হয়। এই পর্যায়ের দুটি অংশ রয়েছে, যথা—

  • (1) সাধারণ আলােচনা এবং
  • (2) অর্থবরাদ্দের দাবির উপর আলােচনা।


অর্থবরাদ্দের দাবির উপর আলােচনা বাজেট সংক্রান্ত আলােচনা শেষ হওয়ার পর আরম্ভ হয়ে থাকে। সাধারণভাবে প্রতিটি মন্ত্রক পৃথক পৃথকভাবে লােকসভায় বা বিধানসভায় অর্থবরাদ্দের দাবি জানিয়ে প্রস্তাব উত্থাপন করে থাকেন। ওই প্রস্তাবের প্রকৃতি হল অনুরােধমূলক। বাস্তবে সংশ্লিষ্ট কক্ষের সময় বাঁচানাের জন্য অধ্যক্ষ নিজেই ওই সমস্ত প্রস্তাব উত্থাপন করে থাকেন। এর ফলে অর্থবরাদ্দের দাবির উপর আলােচনার সময় প্রথমে প্রতিটি মন্ত্রকের নীতি ও কাজকর্ম পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করে দেখা হয়। এর ফলস্বরূপ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রক কর্তৃক অনুসৃত নীতি কক্ষের বিরােধী সদস্যরা অনুমােদন নাও করতে পারেন অথবা ব্যয় সংকোচ এর জন্য নানারকমের ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করতে কিংবা স্থানীয় মানুষের অভাব-অভিযােগের ব্যাপারে মন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে গিয়ে সদস্যরা অর্থবরাদ্দের দাবি সংক্রান্ত মূল প্রস্তাবের যেসব প্রস্তাবগুলি উত্থাপন করেন, সেগুলিকেই ছাঁটাই প্রস্তাব বলা হয়।


ছাত্র ছাত্রীদের সুবিধার্থে আরও সংক্ষেপে বলা যেতেই পারে যে, ভারতীয় সংসদীয় প্রকরণ বিধি অনুযায়ী ছাঁটাই প্রস্তাব হল একটি উল্লেখযােগ্য পরিষদীয় প্রকরণ। লোকসভায় বাজেট পাসের সময় ব্যয়বরাদ্দের দাবি নিয়ে আলােচনায় বিরােধী পক্ষ কোনাে বিষয়ে বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়ার জন্য যে প্রস্তাব উত্থাপন করে, সাধারণভাবে তাকে 'ছাঁটাই প্রস্তাব' বলে (Cut motion)।


ছাঁটাই প্রস্তাবের প্রকারভেদ


সরকারের ব্যয় নীতির সমালােচনার উদ্দেশ্যে বিধানসভা কিংবা লোকসভার বিরােধী দলগুলি ব্যয় হ্রাসের প্রস্তাব করে। এই উদ্দেশ্যে বিরােধী সদস্যরা বিভিন্ন ধরনের ছাঁটাই প্রস্তাব উত্থাপন করে থাকেন। ছাঁটাই প্রস্তাব সাধারণত তিন ভাগে ভাগ করা হয়, যথা— (1) নীতি অনুমােদন সংক্রান্ত ছাঁটাই প্রস্তাব (Disapproval cut), (2) ব্যয় সংক্ষেপের জন্য ছাঁটাই প্রস্তাব (Economy cut), (3) প্রতীকী ছাঁটাই প্রস্তাব (Token Cut)।


(1) নীতি অনুমােদন সংক্রান্ত ছাঁটাই প্রস্তাব: বিরােধীরা সরকারের দাবিকে অস্বীকার করার উদ্দেশ্যে এই ধরনের ছাঁটাই প্রস্তাব উত্থাপন করে থাকেন। নীতি অনুমােদন সংক্রান্ত ছাঁটাই প্রস্তাব সরকারের দাবিকে নামমাত্র অঙ্কে নামিয়ে আনার কথা বলা হয়। যেমন প্রস্তাবে বলা হয়, কোনাে ব্যয়ের দাবিকে ছাঁটাই করে ১ টাকায় নামিয়ে আনতে হবে। এর অর্থ হল যে নীতির ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মন্ত্রী তার প্রস্তাবে ব্যয়বরাদ্দের দাবি জানিয়েছেন সেই নীতিকে ছাঁটাই প্রস্তাবের উত্থাপক হিসেবে অনুমােদন করা হচ্ছে না। বর্তমানে তিন ধরনের ছাঁটাই প্রস্তাবের মধ্যে নীতি অনুমােদন সংক্রান্ত ছাঁটাই প্রস্তাবটিকে অপেক্ষাকৃত কঠিন নীতিরূপে চিহ্নিত করা হয়।


(2) ব্যয়সংক্ষেপের জন্য ছাঁটাই প্রস্তাব: বিশেষ কোনাে খাতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মন্ত্রী ব্যয় বরাদ্দ অনুমােদনের জন্য লোকসভা বা বিধানসভায় দাবি জানান। এক্ষেত্রে ব্যয়সংক্ষেপের উদ্দেশ্যে তার একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ হ্রাস করার জন্য যে প্রস্তাব উত্থাপিত করা হয়, তাকে ব্যয়সংক্ষেপের জন্য ছাঁটাই প্রস্তাব বলা হয়। সরকারের ব্যয়ের দাবি মাত্রাতিরিক্ত মনে করলে লোকসভা তা কমানাের জন্য এই ধরনের ছাঁটাই প্রস্তাব উত্থাপন করতে পারে। এই ধরনের প্রস্তাবে সরকারের ব্যয়ের দাবি একটি নির্দিষ্ট পরিমাণে হ্রাস করার কথা বলা হয়।


(3) প্রতীকী ছাঁটাই প্রস্তাব: তিন ধরনের ছাঁটাই প্রস্তাবের মধ্যে প্রতীকী ছাঁটাই প্রস্তাব লোকসভা এবং রাজ্য বিধানসভায় বেশি উত্থাপিত হয়। কোন মন্ত্রী বিশেষ কোনাে খাতে যে পরিমাণ ব্যয় বরাদ্দের দাবি করেন তার থেকে মাত্র ১০০ টাকা হ্রাস করার জন্য যে প্রস্তাব উত্থাপিত হয়, তাকে 'প্রতীকী ছাঁটাই প্রস্তাব’ বলা হয়। এই ধরনের ছাঁটাই প্রস্তাব উত্থাপনের উদ্দেশ্য, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এবং রাজ্য সরকারকে জনসাধারণের দুঃখ দুর্দশার জন্য দায়ী করা। সরকারের কোনাে অযৌক্তিক ব্যয় বরাদ্দ দাবির বিরুদ্ধে অভিযােগ জানানাের উদ্দেশ্যে বিরােধী পক্ষ 'প্রতীকী ছাঁটাই প্রস্তাব উত্থাপন করে থাকে। প্রস্তাবে কোনাে নির্দিষ্ট খাতে সরকারের ব্যয় বরাদ্দের দাবি সামান্য পরিমাণে ছাঁটাই করার কথা বলা হয়। কোনাে ছাঁটাই প্রস্তাব ভােটে পাস হলে সরকারকে পদত্যাগ করতেই হয়, কারণ ভােটে হেরে যাওয়ার অর্থ হল— সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা হ্রাস পাওয়া এবং সদস্যদের আস্থা হারানাে।


ছাঁটাই প্রস্তাবের গুরুত্ব


সরকারের তরফে উত্থাপিত ব্যয় বরাদ্দ সংক্রান্ত মূল প্রস্তাবের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত যে-কোনাে ধরনের ছাঁটাই প্রস্তাব একইসঙ্গে লােকসভায় আলােচিত হয়। সংশ্লিষ্ট কক্ষ আলােচনা শেষ হওয়ার পর প্রথমেই ছাঁটাই প্রস্তাবগুলির নিষ্পত্তি করে থাকে। এরপর ব্যয় বরাদ্দ দাবি সংক্রান্ত প্রস্তাবটির উপর ভােট গ্রহণ করা হয়।


কিন্তু বর্তমানে ছাঁটাই প্রস্তাবগুলির প্রতীকী গুরুত্ব ছাড়া কোনাে বাস্তব গুরুত্ব নেই বলেই এইরূপ প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার কোনাে সম্ভাবনা থাকে না। এর অন্যতম একটি কারণ হল একটি ছাঁটাই প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার অর্থই হল সরকার লােকসভা বা বিধানসভার আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। এই অবস্থায় আর ক্ষমতায় থাকা সমীচীন কি না, সে বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। কাজেই বলা যায়, লোকসভার সদস্যদের ভােটাভুটির মাধ্যমেই ছাঁটাই প্রস্তাবের ভাগ্য মূলত নির্ধারিত হয়। পরিশেষে বলা যায় যে, ছাঁটাই প্রস্তাব মূলত সরকারের আর্থিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিরােধী পক্ষের একটি ধারালাে মােক্ষম অস্ত্র।