পার্লামেন্টের সদস্যদের বিশেষাধিকার সম্পর্কে আলােচনা করাে।

পার্লামেন্টের সদস্যদের বিশেষাধিকার

ভূমিকা: সংসদীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পার্লামেন্ট বা আইনসভা হল একটি বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান। আইনসভার সদস্যদের অধিকার রক্ষা আইনসভার কার্যপরিচালনার সঙ্গে ওতপ্রােতভাবে জড়িত। অধিকার না থাকলে পার্লামেন্ট তার কাজগুলি যথাযথভাবে সম্পাদন করতে পারে না। তাই পার্লামেন্টের মর্যাদারক্ষার স্বার্থে একদিকে পার্লামেন্ট অন্যদিকে তার সদস্যদের কতকগুলি বিশেষ সুযােগসুবিধা ও অধিকার থাকা বাঞ্ছনীয়। টমাস আরস্কিন মে- এর (Parliamentary Practice) ভাসায়, "আইনসভার কার্যসম্পাদন ও তার সদস্যদের বিশেষ অধিকার একে অপরের পরিপূরক”। আইন বিভাগীয় সুযোগ সুবিধার ক্ষেত্রে ভারতীয় সংবিধান ইংল্যান্ডের রীতিনীতিগুলির কাছে ঋণী। এম ভি পাইলি বলেছেন, “ভারতীয় সংবিধানে সংসদের সদস্যদের বিশেষ অধিকারের বিষয়টি শতবর্ষ পুরাতন ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সাংবিধানিক রীতিনীতির কাছে দায়বদ্ধ” ("The Provision of the Constitution dealing with Parliamentary privileges and immunities bear a special mark of indebtedness to the century-old conventions established and maintained in this regard by the mother of Parliaments, the British Parliament.")।


পার্লামেন্টের বিশেষাধিকারের সংজ্ঞা: পার্লামেন্টের প্রতিটি কক্ষ সমষ্টিগতভাবে এবং সদস্যগণ ব্যক্তিগতভাবে যে সকল অধিকার ভােগ করে তার সমষ্টিকে বলা হয় পার্লামেন্টের বিশেষাধিকার। ভারতের সংবিধান-প্রণেতাগণ পার্লামেন্ট ও তার সদস্যদের অধিকার এবং সুযােগসুবিধা নির্ধারণের ক্ষেত্রে ইংল্যান্ডের কমন্স সভার সদস্যদের অধিকারের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন।


উৎস: ভারতীয় সংবিধানের ১০৫ নং ধারায় পার্লামেন্ট এবং তার সদস্যদের অধিকার ও অব্যাহতি বিষয়ে উল্লেখ আছে। এই অধিকার ও অব্যাহতি সাধারণত দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা (a) সদস্যদের ব্যক্তিগত অধিকার ও অব্যাহতি এবং (b) পার্লামেন্টের সমষ্টিগত অধিকার ও অব্যাহতি।


সংসদের সদস্যদের ব্যক্তিগত অধিকার ও অব্যাহতি


[1] বাকস্বাধীনতা: সংসদের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে বাক্-স্বাধীনতা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে বিবেচিত হয়েছে। ভারতীয় সংবিধানে মৌলিক অধিকার হিসেবে ১৯ নং ধারায় বাস্বাধীনতার বিষয় বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা আছে। কিন্তু সংবিধানের ১০৫ (১) নং ধারা অনুসারে, পার্লামেন্টে প্রত্যেক সদস্যের মতপ্রকাশের অধিকার থাকবে। তবে এই মতপ্রকাশের অধিকার সংবিধান এবং পার্লামেন্টের কার্য পরিচালনা সংক্রান্ত নিয়ম ও স্থায়ী নির্দেশের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে। সংবিধানের ১০৫ (২) নং ধারা অনুসারে, পার্লামেন্ট বা তার কোনাে কমিটিতে কোনাে বক্তব্য রাখার জন্য বা ভােটদানের জন্য কোনো সদস্যকে আদালতে অভিযুক্ত করা যায় না।


[2] গ্রেফতার না হওয়া বিষয়ক স্বাধীনতা: পার্লামেন্টের অধিবেশন চলাকালীন সময়ে সংসদের সদস্যরা গ্রেফতার না হওয়া পর্যন্ত অধিকার ও স্বাধীনতা ভােগ করে থাকেন। অধিবেশন চলাকালীন সময়ে কোনাে সদস্যকে দেওয়ানি মামলায় গ্রেফতার করা যায় না। অধিবেশন শুরু হওয়ার ৪০ দিন আগে এবং অধিবেশন শেষ হওয়ার পর ৪০ দিন পর্যন্ত সদস্যগণ এই অধিকার ভােগ করেন। তবে ফৌজদারি অভিযােগ ও নিবর্তনমূলক আটক আইনের মাধ্যমে গ্রেফতারের এই অধিকার ও অব্যাহতি পাওয়া যায় না। যদিও এই ব্যাপারে কিছু বিধিনিষেধ লক্ষ করা যায়一

  • অভিযুক্ত সাংসদকে গ্রেফতার করতে হলে সংশ্লিষ্ট কক্ষের স্পিকার বা চেয়ারম্যানের অনুমতি প্রয়ােজন হয়।
  • কোনাে সাংসদকে পার্লামেন্টের চত্বর বা সীমানার মধ্য থেকে গ্রেফতার করা হয় না।
  • আইনসভার সীমানার মধ্য থেকে কোনাে সদস্যকে স্পিকার (লোকসভা) কিংবা চেয়ারম্যানের (রাজ্যসভা) অনুমতি ছাড়া দেওয়ানি বা ফৌজদারির সমন দেওয়া যায় না। কিন্তু অধিবেশন বন্ধ থাকাকালীন এই নিয়ম প্রযােজ্য নয়।


[3] জুরি বা সাক্ষী হিসেবে আদালতে উপস্থিত না হওয়ার স্বাধীনতা : পার্লামেন্টের অধিবেশন চলাকালে কোনাে সদস্যকে জুরির সাহায্যে দায়িত্ব পালনে বাধ্য করা যায় না এবং কোনাে সদস্যকে সাক্ষ্য দিতেও বাধ্য করা যায় না।


পার্লামেন্টের সমষ্টিগত অধিকার ও অব্যাহতি


পার্লামেন্টের প্রত্যেক কক্ষ সমষ্টিগতভাবে যে অধিকার ও অব্যাহতি ভােগ করে সেগুলি হল নিম্নরূপ


[1] কক্ষের কার্যপদ্ধতি নির্ধারণ করা: সংসদের কার্যাবলি সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য পার্লামেন্টের প্রত্যেক কক্ষ যথা- লােকসভা ও রাজ্যসভা নিজেদের কর্মপদ্ধতি নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করার অধিকার ভােগ করে। সভার অভ্যন্তরে কোনাে বক্তব্যের কারণে আদালতের হস্তক্ষেপের অধিকার নেই। তবে ব্যতিক্রমী ঘটনা হল- হত্যাকাণ্ড যদি ঘটে তাহলে তা আদালতের এক্তিয়ারের বিষয়বস্তু বলে বিবেচিত হবে।


[2] বহিরাগতদের উপস্থিতি নিষিদ্ধ করার অধিকার: পার্লামেন্টের প্রত্যেক কক্ষ বিতর্ক আলােচনার গোপনীয়তা রক্ষার উদ্দেশ্যে কক্ষের সদস্য নয় এমন ব্যক্তিদের আইনসভার অভ্যন্তরে প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘােষণা করতে পারে। সভার শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার কারণে বা যুদ্ধের সময় পার্লামেন্ট এই অধিকার প্রয়োগ করে থাকে।


[3] অবমাননার জন্য শাস্তি দানের ব্যবস্থা: পার্লামেন্ট বা তার কোনাে সদস্যকে অপমান বা অবমাননা করা হলে কিংবা সদস্যদের বিশেষাধিকার ভঙ্গ হলে পার্লামেন্ট অবমাননাকারীকে শাস্তি দিতে পারে। এই শাস্তি তিন প্রকার一

  • অভিযুক্তকে সভায় উপস্থিত হতে বলা এবং তিরস্কার ও সতর্ক করা,
  • কঠোর ভসনা করা,
  • অভিযুক্ত ব্যক্তির জেলহাজতের ব্যবস্থা করা।


[4] বিতর্ক ও কার্যবিবরণী প্রকাশের অধিকার: পার্লামেন্টের অভ্যন্তরে অধিবেশন চলাকালীন সময়ে যেসব বিতর্ক ও আলােচনা সংসদের উভয় কক্ষে অনুষ্ঠিত হয়, তা প্রকাশ করার অধিকার প্রতিটি কক্ষই সমানভাবে ভােগ করে থাকে। সংবাদপত্র সংসদের বিবরণী স্বাধীনভাবে প্রকাশ করতে পারে। কিন্তু বিকৃত সংবাদ প্রকাশিত হলে সংসদ সেক্ষেত্রে বাধা দিতে পারে।


[5] সংসদের কার্যকাল বৃদ্ধির বিশেষাধিকার: সংসদের গঠনের বিষয়ে ভারতীয় সংবিধানের কর্তৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত থাকলেও, এ বিষয়ে সংবিধানের নির্দেশ অনুযায়ী পার্লামেন্টের কর্তৃত্ব অনেকাংশেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, জাতীয় জরুরি অবস্থা চলাকালীন সময়ে লোকসভার কার্যকালের মেয়াদ এক বছর থেকে বৃদ্ধি করে ছয় বছর করা হয়েছে। সংসদের মােট সদস্য সংখ্যা সংবিধানে নির্দিষ্ট করা থাকলেও কোনাে রাজ্য বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল থেকে কত জন সাংসদ প্রতিনিধিত্ব করবে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নির্ধারণের দায়িত্ব পার্লামেন্টই ভােগ করে থাকে।


পর্যালােচনা: ভারতে পার্লামেন্ট এবং রাজ্য আইনসভার সদস্যদের অধিকার এবং অব্যাহতির বিষয়ে কিছু প্রশ্ন দেখা দেয়। সংসদ ও রাজ্য আইনসভার অধিকারসমূহ বিধিবদ্ধ করা উচিত কি না এ বিষয়ে মতপার্থক্য বর্তমান থাকলেও কতকগুলি প্রশ্ন থেকেই যায়, যেমন

  • প্রথমত: পার্লামেন্ট এবং রাজ্য আইনসভার সদস্যদের অধিকার এবং অব্যাহতির অধিকার প্রয়ােগ সংক্রান্ত ক্ষমতা সংবিধানের তৃতীয় অধ্যায়ে স্বীকৃত মৌলিক অধিকার দ্বারা খর্ব করা যায় কি না, এ বিষয়ে সংশয় সৃষ্টি হতে পারে।
  • দ্বিতীয়ত: অধিকার ভঙ্গ বা অবমাননার জন্য আইনসভায় উপস্থিত হওয়ার নির্দেশ অমান্য করে আদালতের সাহায্য গ্রহণ করা যায় কি না বা আইনসভার অধিকার ভঙ্গ হয়েছে কি না এই বিষয়ে আদালতের কোনাে ক্ষমতা আছে কি না সেই বিষয় সংক্রান্ত পর্যালোচনা। করাটা প্রয়ােজনীয় বিষয় বলে বিবেচিত হতে পারে।
  • তৃতীয়ত: মাননীয় অধ্যক্ষ সভার কার্যবিবরণী থেকে যে অংশ বাদ দিয়েছেন সেই অংশ সংবাদপত্রে প্রকাশ করলে অধিকার ভঙ্গের পর্যায়ে পড়ে কি না, এরকম আরও বহু প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই উত্থাপন করা যেতে পারে।


উপসংহার: বস্তুত সংসদ ও রাজ্য আইনসভা এবং তার সদস্যদের বিশেষাধিকার ও অব্যাহতি ভােগের ক্ষেত্রে অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতার অস্তিত্ব সমর্থন করা যায় না। অনেকক্ষেত্রে আইনসভার বিশেষাধিকার দ্বারা জনগণের মৌলিক অধিকার নিয়ন্ত্রিত হতে পারে। তা ছাড়া যেহেতু ভারতের শাসনব্যবস্থা সংসদীয়, তাই এই ধরনের মন্ত্রীসভা দলীয় আনুগত্যের মাধ্যমে আইনসভার নিজ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে। তার ফলে আইনসভার বিশেষাধিকারসমূহের প্রয়োগ মন্ত্রীসভার হাতে অন্যতম অস্ত্র হিসেবে কাজ করে। এই কারণে আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগের মধ্যে সংঘাত সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তা ছাড়া সংসদ জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও অভাব-অভিযােগের প্রতিকারের পরিবর্তে কেবলমাত্র বিশেষাধিকার যদি ভােগ করে তাহলে সংসদীয় গণতন্ত্র কলুষিত হয়ে পড়বে। অবশ্য একইসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে, সংসদীয় দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে বাকস্বাধীনতা অপরিহার্য বলে বিবেচিত হয়। সুপ্রিম কোর্টের সার্চলাইট মামলার রায় প্রণিধানযােগ্য। সুপ্রিম কোর্টের রায় হল ১০৫ নং ধারাবলে সাংসদরা যে বাক স্বাধীনতা উপভোগ করে তা শুধুমাত্র সংসদের কার্যাবলি পরিচালনার জন্য, যা সাংবিধানিক রীতিনীতির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে।


সরকারের উপর পার্লামেন্টের নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি | ভারতীয় পার্লামেন্ট কোন কোন উপায়ে মন্ত্রীপরিষদকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে?


ভারতীয় পার্লামেন্টের কমিটি ব্যবস্থার পর্যালোচনা করাে।


ভারতের পার্লামেন্টে সরকারি হিসাব পরীক্ষা (গাণিতিক) কমিটির গঠন, ক্ষমতা ও কার্যাবলি আলােচনা করো।