ভারতের উপরাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থীর যােগ্যতাবলি, নির্বাচন পদ্ধতি ও কার্যকাল | ভারতের উপরাষ্ট্রপতি ক্ষমতা ও পদমর্যাদা

উপরাষ্ট্রপতি ক্ষমতা ও পদমর্যাদা

ভূমিকা: ভারতের উপরাষ্ট্রপতি পদ আলঙ্কারিক পদ। ভারতীয় সংবিধানের ৬৩-৬৯ নং ধারায় উপরাষ্ট্রপতি পদ সম্পর্কে আলােচনা করা হয়েছে। সংবিধানের ৬৪নং ধারায় বলা হয়েছে- "The Vice-President to be ex-officio chairman of the council of the State”। উপরাষ্ট্রপতি হলেন পদাধিকারবলে রাজ্যসভার সভাপতি বা চেয়ারম্যান। ভারতের উপরাষ্ট্রপতি পদের গুরুত্ব তার চেয়ারম্যান পদকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়।


উপরাষ্ট্রপতির নির্বাচনের যােগ্যতা: সংবিধানের ৬৬ ধারায় উপরাষ্ট্রপতির নির্বাচন সম্পর্কে বলা হয়েছে যেㅡ

  • উপরাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থীকে অবশ্যই ভারতীয় নাগরিক হতে হবে।
  • কমপক্ষে ৩৫ বছর বয়স্ক হতে হবে।
  • রাজ্যসভার সদস্য নির্বাচিত হওয়ার যােগ্যতাসম্পন্ন হতে হবে।
  • উপরাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বা রাজ্য সরকারের কিংবা সরকার অধীনস্থ কোনাে সংস্থার লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত থাকতে পারবেন না।
  • বর্তমান আইন অনুযায়ী উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনে পদপ্রার্থীর নাম কমপক্ষে ৫ জন প্রস্তাবক এবং ৫ জন সমর্থক দ্বারা সমর্থিত হতে হবে (১৯৭৪ খ্রি.)।

তা ছাড়া উপরাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থীর মনােনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় ১৫,০০০ টাকা জামানত হিসেবে জমা রাখতে হয়। ব্যতিক্রম হিসেবে বলা যায় যে, কোনাে সংসদ সদস্য বা রাজ্য আইনসভার কোনাে কক্ষের সদস্য যদি উপরাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বিজয়ী হন তাহলে শপথগ্রহণের পূর্বে তাকে সেই পদ থেকে ইস্তফা দিতে হয়।


উপরাষ্ট্রপতির নির্বাচন


রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতির মতাে উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনের জন্য একটি নির্বাচকমণ্ডলী (Electoral College) গঠন করার কথা সংবিধানে বলা হয়েছে। লোকসভা ও রাজ্যসভার সকল নির্বাচিত ও মনােনীত সদস্য এই নির্বাচক সংস্থার সদস্য। মূল সংবিধানে লোকসভা ও রাজ্যসভার সদস্য বৃন্দ যৌথভাবে উপরাষ্ট্রপতির নির্বাচনে ভোট দিতেন কিন্তু সংবিধানের একাদশতম সংবিধানের-সংশোধনী আইন অনুসারে বর্তমানে পার্লামেন্টের উভয় কক্ষের সদস্য পৃথকভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়ােগ করেন। অর্থাৎ পার্লামেন্টের উভয় কক্ষের সদস্যদের দ্বারা একক হস্তান্তরযােগ্য সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে গােপন ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। যদিও মূল সংবিধানে বলা হয়েছে যে, পার্লামেন্টের উভয় কক্ষের যৌথ অধিবেশনেই উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবেন। কিন্তু ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দের একাদশ সংশােধনী আইন অনুসারে এই ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে বর্তমানে নতুন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।


উপরাষ্ট্রপতির কার্যকাল ও পদচ্যুতি


রাষ্ট্রপতির কার্যকাল ৫ বছর। তিনি পুনর্নির্বাচিত হতে পারেন। তিনি কার্যকাল শেষ হওয়ার আগে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করতে পারেন। সংবিধান ভঙ্গের অভিযােগে তাকে পদচ্যুতও করা যায়। উপরাষ্ট্রপতি কে পদচ্যুত করার জন্য ইমপিচমেন্ট পদ্ধতির প্রয়ােজন হয় না। তাকে পদচ্যুত করার জন্য রাজ্যসভার প্রস্তাবক্রমে ১৪ দিন পূর্বে নােটিশ দিতে হয়। রাজ্যসভার মােট সদস্যের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে গৃহীত পদচ্যুতি সংক্রান্ত প্রস্তাব লোকসভায় গৃহীত হলে উপরাষ্ট্রপতি পদচ্যুত হন। ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে ৪৪তম সংবিধান সংশােধনী আইনে বলা হয়েছে যে, যদি রাষ্ট্রপতির নির্বাচনকে ঘিরে কোনােরূপ বিতর্কের উদ্ভব ঘটে তাহলে সেই বিতর্কের মীমাংসা সুপ্রিমকোর্টই করে থাকে। রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হলে ৬ মাসের মধ্যে নতুন রাষ্ট্রপতি কে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হয়।


উপরাষ্ট্রপতির বেতন, ভাতা ও অন্যান্য সুযােগসুবিধা


বর্তমানে ভারতের উপরাষ্ট্রপতি নতুন সংশােধিত বেতন কাঠামাে অনুসারে বেতন, ভাতা এবং অন্যান্য সুযােগসুবিধা ভােগ করেন। উপরাষ্ট্রপতি বর্তমানে ৪,০০,০০০ টাকা বেতন ও ভাতা পান। উপরাষ্ট্রপতি সাময়িকভাবে রাষ্ট্রপতির মতাে দায়দায়িত্ব পালন করেন এবং উপযুক্ত বেতন ও ভাতা ভােগ করে থাকেন।


উপরাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও পদমর্যাদা


সংবিধান অনুসারে ভারতের মহামান্য রাষ্ট্রপতির পরেই মর্যাদাজনক স্থানটি হল উপরাষ্ট্রপতির। সাধারণভাবে উপরাষ্ট্রপতির পদের সঙ্গে কোনাে বিধিবদ্ধ দায়দায়িত্ব জড়িত থাকে। উপরাষ্ট্রপতি হলেন পদাধিকারবলে রাজ্যসভার সভাপতি এবং রাজ্যসভা পরিচালনার দায়দায়িত্ব তার উপরেই ন্যস্ত থাকে।


[1] সংবিধানের ৬৪নং ধারা অনুযায়ী রাজ্যসভায় সভাপতিত্ব করাই উপরাষ্ট্রপতির সর্বপ্রধান কাজ।


[2] মৃত্যু, পদত্যাগ, অপসারণ বা অন্যকোনাে কারণে রাষ্ট্রপতির আসন শূন্য হলে অস্থায়ীভাবে উপরাষ্ট্রপতি সেই দায়িত্ব পালন করেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, মার্কিন রাষ্ট্রপতি কেনেডি-র মৃত্যুর পর তৎকালীন উপরাষ্ট্রপতি জনসন রাষ্ট্রপতির পদে উন্নীত হন। তবে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এই নিয়ম গ্রহণ করা হলেও ভারতে কিন্তু এই রীতি মান্য করা হয় না। এই কারণে অনেকে মনে করেন ভারতে উপরাষ্ট্রপতির সাংবিধানিক গুরুত্ব কম, তিনি কেবলমাত্র রাজ্যসভা এবং রাষ্ট্রপতির মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ভূমিকা পালন করে থাকেন। কার্যনির্বাহী রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পেলে উপরাষ্ট্রপতি তখন রাষ্ট্রপতির মতো সকল সুযােগসুবিধা ভােগ করেন।


[3] অসুস্থতা, বিদেশ ভ্রমণ অথবা অন্যকোনাে কারণে রাষ্ট্রপতি যদি সাময়িকভাবে অনুপস্থিত থাকেন, সেরকম ক্ষেত্রেও উপরাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রপতির কাজ চালিয়ে যেতে পারেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে জ্ঞানী জৈল সিং অসুস্থ হয়ে আমেরিকায় চিকিৎসার জন্য গেলে উপরাষ্ট্রপতি হিদায়েতুল্লা অ্যাক্টিং প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন।


[4] উপরাষ্ট্রপতি যখন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে তার ভূমিকা পালন করেন তখন কিন্তু তিনি রাজ্যসভার সভাপতি বা চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হন না (৬৪নং অনুচ্ছেদ)।


[5] ভারতের সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় উপরাষ্ট্রপতির ভূমিকা দুটি ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকে一

  • রাজ্যসভার চেয়ারম্যান হিসেবে তাঁর ভূমিকা পালন,
  • অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে সংসদে দায়িত্ব পালন।

ভারতের শাসন ব্যবস্থায় উপরাষ্ট্রপতি হয়তো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপরাষ্ট্রপতির অনাবশ্যক মহামহিম (His Superfluous Highness)  নন, কিন্তু তার পদটি মার্কিন রাষ্ট্রপতির মতোই উচ্চাকাঙ্ক্ষা সম্পন্ন রাজনীতিবিদদের সমাধিস্থল’ সে-কথা অনেকেই স্বীকার করে থাকেন। তবে সাম্প্রতিককালে উপরাষ্ট্রপতির বিভিন্ন বিদেশ সফর তার পদের গুরুত্ব বৃদ্ধি করে বলে দাবি করা হয়। দক্ষ প্রশাসক, কূটনীতিবিদ ও সুপণ্ডিত হিসেবে উপরাষ্ট্রপতি তার পদের মর্যাদা বৃদ্ধি করেছেন এমন দৃষ্টান্ত ভারতে বহু আছে। যেমন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি একাধারে বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ, শিক্ষাবিদ জাকির হােসেন, শ্রমিক নেতা ভি ভি গিরি, আইনজ্ঞ হিদায়েতুল্লা, সমাজসেবী শঙ্কর দয়াল শর্মা এবং পণ্ডিত কে আর নারায়ণনের ভূমিকা প্রশংসনীয়।


মূল্যায়ন: উপরাষ্ট্রপতি পদ আলঙ্কারিক পদ সে বিষয়ে কোনাে সন্দেহ নেই। আগে পদমর্যাদার তালিকায় রাষ্ট্রপতির স্থান তৃতীয় হলেও, বর্তমানে তত্ত্বগতভাবে ভারতের উপরাষ্ট্রপতি দ্বিতীয় পদমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি। যেমন— বর্তমানে ভেঙ্কাইয়া নাইডু ৫১৬ টি ভােট পেয়ে উপরাষ্ট্রপতি পদে নিযুক্ত হয়েছেন। তবে সাংবিধানিক বিচারে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ পদ হলেও এ পর্যন্ত উপরাষ্ট্রপতি পদে আসীন সকল সশ্রদ্ধ উপরাষ্ট্রপতি ভারতের গৌরব বৃদ্ধি করেছেন। তবে উপরাষ্ট্রপতি পদের পদমর্যাদা অনেকটা নির্ভরশীল পদাধিকারীর ব্যক্তিত্ব, ব্যক্তিগত যােগ্যতা, দক্ষতা, কর্মকুশলতা, দূরদর্শিতা প্রভৃতির উপর। পাইলির মতানুসারে, সম্মান ও মর্যাদাগত বিচারে ভারতের উপরাষ্ট্রপতির পদ মােটামুটি গুরুত্বপূর্ণ ("..the office of the Vice President has been one of great dignity and prestige.")