ভারতের কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রকৃত্যক কমিশনের গঠন ও কার্যাবলি আলােচনা করাে।

ভূমিকা: বর্তমানে ভারতের উচ্চতর রাষ্ট্রীয় পরিসেবায় দক্ষ ও যােগ্য প্রার্থী নির্বাচনের জন্য তিন ধরনের কমিশন রয়েছে। সেগুলি হল

  • (A) কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রকৃত্যক কমিশন,
  • (B) রাজ্য রাষ্ট্রকৃত্যক কমিশন,
  • (C) যুগ্ম রাষ্ট্রকৃত্যক কমিশন।

এই তিনটি কমিশনই আলাদা আলাদাভাবে সরকারি পরিসেবার জন্য কর্মীদের নিয়ােগ করে থাকে। কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রকৃত্যক কমিশন সর্বভারতীয় ও কেন্দ্রীয় সরকারি পরিসেবার জন্য সরকারি কর্মচারীদের নিয়ােগ করে। রাজ্য রাষ্ট্রকৃত্যক কমিশন সংশ্লিষ্ট রাজ্যের সরকারি পরিসেবার সঙ্গে যুক্ত কর্মচারীদের নিয়ােগ করে থাকে এবং কিভাবে যুগ্ম রাষ্ট্রকৃত্যক কমিশন সংশ্লিষ্টরাজ্যগুলির জন্য কর্মী নিয়ােগ করে থাকে।


কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রকৃত্যক কমিশনের গঠন: সংবিধান ৩১৬নং ধারানুসারে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রকৃত্যক কমিশন একজন সভাপতি ও অন্যান্য কয়েকজন সদস্য নিয়ে গঠিত হলেও সংবিধানে এ কথা উল্লেখ করা হয়নি যে, কমিশনে কতজন সদস্য থাকবে। কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রকৃত্যক কমিশনের মােট সদস্য সংখ্যা (৯-১১ জন) রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নির্ধারিত হওয়ার কথা বলা হয়েছে। বলা যেতে পারে, কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকারের অধীনে কমপক্ষে ১০ বছর কাজের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ব্যক্তিকে কমিশন সদস্য হিসেবে নিযুক্ত করে থাকে। স্থায়ী সভাপতি নিযুক্ত না হওয়া পর্যন্ত অস্থায়ী সভাপতি এই কমিশনের দায়িত্ব পালন করে থাকেন।


কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রকৃত্যক কমিশনের সদস্যদের কার্যকাল: কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রকৃত্যক কমিশনের সভাপতি ও সদস্যদের কার্যকালের মেয়াদ ৬ বছর। তবে ৬ বছরের কার্যকাল শেষ হওয়ার আগেই যদি কেউ ৬৫ বছর বয়সে পৌছে যান তাহলে তাকে কমিশন থেকে পদত্যাগ করতে হয়। কমিশনের সদস্যদের তাদের পদত্যাগপত্র রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করতে হয়। সংবিধানে উল্লেখ করাই আছে যে, কোনাে সদস্য দ্বিতীয় বার কমিশনের সদস্য হিসেবে পুনঃ নিযুক্ত হতে পারেন না।


কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রকৃত্যক কমিশনের সদস্যদের অপসারণ: সংবিধানের ৩১৭ নং ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রকৃত্যক কমিশনের সদস্যদের রাষ্ট্রপতি নানা কারণে এবং বিভিন্ন পদ্ধতিতে পদচ্যুত করতে পারেন। উদারণস্বরূপ বলা যায় যে―

  • (a) কমিশনের সভাপতি বা অন্য কোনাে সদস্য দেউলিয়া বলে বিবেচিত হলে অপসারণ করতে পারেন।
  • (b) সদস্য বা সভাপতি থাকাকালে কোনাে লাভজনক পদ বা চাকরি গ্রহণ করলে অপসারণ করতে পারেন।
  • (c) রাষ্ট্রপতির মতানুসারে মানসিক বা শারীরিক দুর্বলতার কারণে সদস্য থাকার অনুপযুক্ত বলে বিবেচিত হলে, অপসারণ করতে পারেন [ ৩১৭ (৩) ধারা]।


তবে রাষ্ট্রপতি কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রকৃত্যক কমিশনের সদস্যদের অসদাচরণের অভিযােগ সুপ্রিমকোর্টের কাছে প্রথমে পাঠান। এরপর সুপ্রিমকোর্ট যথাযথ অনুসন্ধানের পর অভিযোগ সত্য বলে রিপাের্ট দিলে তবেই কেবল রাষ্ট্রপতি ১৪৫ নং ধারা মেনে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রকৃত্যক কমিশনের কোনাে সদস্যকে অপসারণ করতে পারেন। এইসকল নির্দিষ্ট কারণ ও পদ্ধতি ছাড়া অন্য কোনােভাবে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রকৃত্যক কমিশনের সদস্যদের অপসারণ করা যায় না। এর ফলে প্রত্যেক সদস্যই সরকারের থেকে নিয়ন্ত্রণমুক্ত থাকেন এবং নিরপেক্ষভাবে তাদের কর্তব্য পালন করেন।


কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রকৃত্যক কমিশনের ক্ষমতা ও কার্যাবলি

সংবিধানের ৩২০ নং ধারায় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রকৃত্যক কমিশনের ক্ষমতা ও কার্যাবলি বিস্তারিতভাবে আলােচিত হয়েছে, নিম্নে তা আলােচনা করা হল一


(1) প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার ব্যবস্থা: কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রকৃত্যক কমিশনের প্রথম ও প্রধান কাজ হল কেন্দ্রীয় ও সর্বভারতীয় চাকরিগুলির জন্য কর্মচারী নিয়ােগের উদ্দেশ্যে প্রতিযােগিতামূলক পরীক্ষার ব্যবস্থা করা। এই উদ্দেশ্যে কমিশন দু-ধরনের পরীক্ষার ব্যবস্থা করে থাকে一 (a) লিখিত পরীক্ষা, (b) মৌখিক পরীক্ষা। উভয়ের দ্বারাই কমিশন কর্মচারীদের নিয়ােগ করে থাকেন।


(2) নিজ রাজ্য বা সংশ্লিষ্ট রাজ্যের জন্য কর্মচারী নিয়ােগের ব্যবস্থা: সংবিধানের ৩২০ (২) নং ধারানুযায়ী দুই বা তার অধিক অঙ্গরাজ্যের সরকার অনুরােধ করলে কমিশন সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলির জন্য প্রার্থী বাছাই করার ব্যবস্থা করতে পারে। কমিশন অনুরােধকারী রাজ্যগুলির জন্য সরকারি কর্মচারী নিয়ােগের ব্যাপারে প্রয়ােজনীয় নিয়মকানুন প্রণয়ন করে দিতে পারে এবং সংশ্লিষ্ট নিয়মাবলিকে কার্যকর করার ব্যাপারে সহযােগিতা করতে পারে।


(3) কার্যাবলিগুলিকে সম্প্রসারণ করা: পার্লামেন্ট আইন প্রণয়ন করে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রকৃত্যক কমিশনের কার্যাবলি সম্প্রসারিত করতে পারে (৩২১ নং ধারা)। কার্যাবলিকে সম্প্রসারণের এই সুযোগ কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রকৃত্যক কমিশনের রয়েছে।


(4) বাৎসরিক প্রতিবেদন প্রস্তুত করা: সংবিধানের ৩২৩ নং ধারানুসারে কমিশনকে রাষ্ট্রপতির কাছে তার কার্যকলাপ সম্পর্কে বাৎসরিক প্রতিবেদন পেশ করতে হয়। এই বাৎসরিক প্রতিবেদনে যে বিষয়গুলি উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলি হল কমিশন কী কী কাজ করছে, কমিশনের পরামর্শ কোথায় সরকার গ্রহণ করেছে এবং কোথায় করেনি সেগুলি বলা হয়েছে। এই বাৎসরিক প্রতিবেদনটি সরকারের বক্তব্য-সহ রাষ্ট্রপতি পার্লামেন্টে পেশ করেন।


(5) সরকারকে পরামর্শ দান: কর্মচারী নিয়ােগ সংক্রান্ত ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির প্রধান পরামর্শদাতা হলেন কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রকৃত্যক কমিশন। কমিশন যে যে বিষয়গুলিতে রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দিয়ে থাকেন, সেই বিষয়গুলি হলㅡ

  • (a) অসামরিক চাকরি ও পদসমূহে নিয়ােগের পদ্ধতি।
  • (b) সরকারি কর্মচারীদের নিয়ােগ, পদোন্নতি, বদলির ক্ষেত্রে প্রার্থীর যােগ্যতা।
  • (c) কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকারের অধীনে থাকা সরকারি কর্মচারীদের শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিষয়।
  • (d) কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে আনীত মামলা-মোকদ্দমার ব্যয় নির্বাহ সংক্রান্ত বিষয়।
  • (e) সরকারি কর্মচারী কোনাে কারণে আঘাতপ্রাপ্ত হলে সেইসময় যদি সে পেনশনের দাবি করে, তাহলে ওই পেনশন এবং তার পরিমাণ সংক্রান্ত বিষয়।


(6) অনুমােদন সাপেক্ষে কার্যাবলি সম্পাদন: রাজ্যের রাজ্যপালের অনুরােধক্রমে এবং রাষ্ট্রপতির অনুমােদন সাপেক্ষে, কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রকৃত্যক কমিশন রাজ্যের যে-কোনো প্রয়ােজন পূরণের কাজ সম্পূর্ণ করে থাকে।


কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রকৃত্যক কমিশনের কার্যাবলী সীমাবদ্ধতা


(1) কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রকৃত্যক কমিশন হল সংবিধান-স্বীকৃত পরামর্শদানকারী সংস্থা, তা সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় সরকার বা রাজ্য সরকার সরকারি কর্মচারী নিয়ােগের ক্ষেত্রে এই কমিশনের পরামর্শ উপেক্ষা করতেই পারে, সরকার খুশিমতাে কর্মচারী নিয়ােগ করতে পারে।


(2) কিছু বিশেষ ধরনের আধিকারিক নিয়ােগের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রকৃত্যক কমিশনকে অগ্রাহ্য করে সরকার নিজেই সদস্যদের নিয়ােগ করতে পারেন। এই ধরনের ঘটনা বিশেষ করে অস্থায়ী পদগুলির সদস্যদের নিয়ােগের ক্ষেত্রে ঘটে থাকে।


(3) কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে কমিশনের পরামর্শ উপেক্ষা সংক্রান্ত বিষয়ে রাষ্ট্রপতি নিয়মকানুন তৈরি করতে পারেন। যদিও এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্রিসভার মূল ক্ষমতাটা ভােগ করে থাকেন এবং রাষ্ট্রপতি কার পরামর্শ অনুসারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকেন। এর ফলে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রকৃত্যক কমিশনের গুরুত্ব অনেকাংশেই হ্রাস পায়।


(4) পার্লামেন্ট সংবিধান-সংশােধনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রকৃত্যক কমিশন ও রাষ্ট্রকৃত্যক বিধিব্যবস্থার পরিবর্তন করতে পারে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা সংসদের এই ক্ষমতা ব্যবহারের মাধ্যমে কমিশনের ক্ষমতা হ্রাস করতে উদ্যোগী হতে পারে। এ ব্যাপারে ৭ম (১৯৫৬), ১৫তম (১৯৬৩), ২৮তম (১৯৭২), ৪২তম (১৯৭৬) সংবিধান-সংশোধন হল উল্লেখযােগ্য।


মূল্যায়ন: সরকারের কার্যাবলি, সাফল্য ও ব্যর্থতা অনেকাংশেই সরকারি কর্মচারীদের দক্ষতা ও যােগ্যতার উপর নির্ভর করে। এই কারণে এই প্রশাসনের মাধ্যমে দক্ষ ও যােগ্য সরকারি কর্মচারী নিয়োগ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে বিবেচিত হয়।


ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মন্ত্রীসভার সম্পর্ক | মন্ত্রীপরিষদের নেতা হিসেবে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা


ক্যাবিনেট সচিবালয় | ভারতবর্ষের প্রশাসনে ক্যাবিনেট সচিবালয়ের কার্যাবলি | ক্যাবিনেট সচিবালয়ের গঠন


প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের গঠন, কার্যাবলি ও বিশেষ ভূমিকাগুলি আলােচনা করাে।