বর্তমান যুগে ভারতে বিশ্বায়নের প্রভাব বা ফলাফল পর্যালোচনা করো।

ভূমিকা: আন্তর্জাতিক রাজনীতির অন্যতম প্রধান ধারণা হল বিশ্বায়ন বা Globalization। ইউরোপ ও আমেরিকার বহুজাতিক ও আন্তঃমহাদেশীয় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলি ও অর্থ লগ্নিকারী সংস্থাগুলি চাইছিল সারা বিশ্ব জুড়ে একটি মুক্ত অর্থনীতি। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে কর ব্যবস্থা ও দেশীয় আইনের কৃত্রিম বেড়াজালকে ছিন্নভিন্ন করে সারা বিশ্বব্যাপী এক অভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ করা। এরই ফলশ্রুতি হল আজকের দুনিয়ার সবচেয়ে বিতর্কিত বিষয় বিশ্বায়ন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঘটে যাওয়া বিশ্বায়নের প্রভাব ও ফলাফল পড়তে শুরু করেছে দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে। উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে ব্রিটিশ শাসকরা একদিকে যেমন অর্থলগ্নি করে অন্যদিকে নানাভাবে তারা ভারতের সম্পদ লুঠ করে ভারতকে নিঃস্ব-রিক্ত করে তােলে। একপেশে মুক্ত বাণিজ্য নীতি প্রয়ােগ করে ভারতীয় অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেয়, বর্তমানকালেও সেই ধারা প্রবহমান ও ক্রমবর্ধমান।


ভারতে বিশ্বায়নের প্রভাব বা ফলাফল

বহুচর্চিত ও আলােচিত বিশ্বায়ন ভারতে যে প্রভাব বিস্তার করেছে, তা নিম্নে সূত্রাকারে আলােচনা করা হল一


(১) ভারতের কৃষিতে সবুজ বিপ্লব হলেও সামগ্রিক উন্নতি হয়নি: আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অর্থনীতিবিদ অমিয় কুমার বাগচী লিখেছেন, 'বিশ্বের ক্রমপরিবর্তনশীল প্রযুক্তি ও বর্তমান বাণিজ্যের পূর্ণসুযােগ গ্রহণের জন্য সামাজিক ও রাজনৈতিক ভিত্তি ভারতে তৈরি না হওয়ায় পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় ভারতের আর্থিক অগ্রগতি ঘটেছে ধীর কচ্ছপ গতিতে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, স্বাধীনতা লাভের পর বিদেশের সঙ্গে ভারতের যােগাযােগ ব্যবস্থার উন্নতি, ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে ব্যাংক জাতীয়করণ, অল্প সুদে কৃষি ও শিল্পের জন্য ব্যাংক থেকে ঋণের ব্যবস্থা, পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাকে সামনে রেখে (১৯৫৬-৬৪ খ্রি.) দ্রুত শিল্পায়ন। ১৯৬০-এর দশকে ভারতের কৃষিতে সবুজ বিপ্লব ঘটে কিন্তু সাধারণ নিম্নবিত্ত মানুষ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত থাকায় সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি পায়নি, বিশ্বের অগ্রগতির সঙ্গে সমানতালে ভারতের প্রযুক্তিবিদ্যার উন্নতি হয়নি, যার ফলে ভারতের কোনাে একটি রাজ্যে সবুজ বিপ্লব ঘটলেও সারা দেশের সামগ্রিক উন্নতি হয়নি।


(২) বৈদেশিক বাণিজ্যের ঘাটতিপূরণে বিদেশি ঋণ গ্রহণ: বিশ্বায়নের যুগে ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধির আমলে পরিস্থিতি উদারীকরণের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং ভারতের বিশ্বায়নের দরজা-জানালা খুলে দেন, তখন বিশ্বায়নের সমর্থকরা সমন্বয়ে দাবি জানান যে, ভারতীয় অর্থনীতিকে বিশ্ব অর্থনীতির দোসর করে তুলতে হলে ভারতের বিশ্বায়নকে বরণ করে নিতে হবে যাকে তখন বলা হয় TINA অর্থাৎ There Is No Alternative I এক সময় থেকেই ভারতে বিশ্বায়ন তার প্রকৃত ব্যাঘ্র-থাবা বসাতে থাকে এবং তার প্রভাব ভারতের বাজারেও পড়তে থাকে। বিলগ্নিকরণ, বেসরকারিকরণ, উদারীকরণ ও বিশ্বায়নের চাপ ভারত সরকারকে বেসামাল করে দেয়। বিশ্বায়নের মুখ্য প্রবক্তা হিসেবে পরিচিত আমেরিকা, ইংল্যান্ড মহাজনি পুঁজির ব্যাবসা সম্প্রসারণের মাধ্যমে IMF, World Bank, MNC-এর মতাে বহুজাতিক কোম্পানিগুলিকে ঋণের ফাদে ফেলে দেয় এবং এই পরিকল্পনার মাধ্যমে ভারত নতুনভাবে শােষণের মুখে পড়ে।


(৩) টাকার অবমূল্যায়ন ও বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি: ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে নতুন জনতা সরকার ভারতে ক্ষমতায় এসে ভারতীয় অর্থনীতির তেমন কোনাে উল্লেখযােগ্য পরিবর্তনসাধন করতে না পারায় টাকার অবমূল্যায়ন ঘটে ও জাতীয় কোশাগারে বিদেশি মুদ্রার টান পড়ে। একসময় কয়েক হাজার টন সােনা বিদেশের ব্যাঙ্কে বন্ধক রাখতে হত। অধ্যাপক অমিয় কুমার বাগচী লিখেছেন, সম্ভাব্য অবমূল্যায়নের সুবিধা নেওয়ার জন্য এদেশের পুঁজিপতিদের একটি অংশ এবং বুর্জোয়া শ্রেণির কিছু প্রতিনিধি কোটি কোটি কালাে টাকা, কালাধন বিদেশে পাচার করে দিয়েছিল, ফলে কোশাগারে বিদেশি মুদ্রায় টান পড়ে।


(৪) প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাওয়ের আমল: পি ভি নরসিমহা রাও IMF, World Bank-এর প্রস্তাবিতা ভারতীয় বাজারের কাঠামােগত সংস্কার শর্তে বিদেশি ঋণ গ্রহণ করেন এবং এদেশের বাজার বিশ্বায়নের কারবারিদের কাছে উন্মুক্ত করে দেন। এ ছাড়াও বহুজাতিক পুঁজির গমনাগমনের পথ-সহ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সরকারি হস্তক্ষেপ বন্ধ করেন, আমদানি শুল্ক হ্রাস করেন, বাণিজ্যগােষ্ঠীর অবাধ বিনিয়ােগের সুযােগ ও স্বাধীনতা প্রদান করেন। এর ফলে ভারতবর্ষ হয়ে ওঠে বিশ্বায়নের সবচেয়ে বড়াে মৃগয়াক্ষেত্র।


(৫) অসতর্কতার কুফল: ভারতবাসীর কাছে বিশ্বায়নের ফল ভালাে হয়নি বলে অনেকে মনে করেন। মুক্ত বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে ভারতে যে বিদেশি পুঁজি আসছে তা উৎপাদন প্রযুক্তি ও পরিকাঠামো-সহ দীর্ঘমেয়াদি কোনাে প্রকল্পে বেশি বিনিয়োগ হচ্ছে না, বেশি বিনিয়োগ হচ্ছে শেয়ার কেনাবেচায়। অসতর্ক বিশ্বায়ন নীতির কুপ্রভাব দেখা গেছে ব্যাংক স্ক্যাম ক্ষেত্রে। একসময় ভারতীয় বাজার থেকে লক্ষ লক্ষ মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্তের সঞ্চিত অর্থ কপূরের মতাে উবে যায়, এখনও এই ধারা বহমান।


(৬) হায়ার এবং ফায়ার নীতি: বিশ্বায়নের প্রভাবে ভারতের কাঠামােগত সংস্কার প্রক্রিয়া বহু শ্রমজীবী মানুষের রুটিরুজির উপর করুণ প্রভাব ফেলেছে। বিশ্বায়ন ভারতের সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের কাছে কোনাে সুফল পৌছে দিতে পারেনি। বিদেশি সংস্থার কলকারখানার সঙ্গে দেশীয় কলকারখানা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার ফলে বহু কলকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, ফলে কাজ হারিয়েছে হাজার হাজার দক্ষ-অদক্ষ শ্রমিক। IMF, World Bank-এর সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়িত করতে গিয়ে Hire and Fire নীতি প্রয়ােগ করা হয়। এর অর্থ হল কাজ থাকলে ডেকে নেওয়া, কাজ না থাকলে তাড়িয়ে দেওয়া─ এই নীতি প্রয়ােগের ফলে বহু শ্রমিকের জীবনে নেমে এসেছে দুঃখের করাল ছায়া।


(৭) ভারতের কৃষি-অর্থনীতির উপর ক্ষতিকর প্রভাব: ভারতের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির উপর বিশ্বায়নের ক্ষতিকর প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। বিশ্বায়ন পুরোপুরি পণ্য নির্ভর ও শিল্প মুখি হওয়ায় কৃষি উৎপাদনের বৃদ্ধির হার কমেছে বহুগুণ, তা ছাড়া রপ্তানিযােগ্য কৃষি পণ্যের উপর জোর দেওয়ার ফলে কোথাও কোথাও খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে।


(৮) শিল্পায়ন, নগরায়ণ এবং সেচ বাঁধ নির্মাণের কারণে কৃষিজমি নষ্ট: বিশ্বায়নের দাপটে আজ ভারতের কৃষক কুলের বিপন্ন। নগরায়ণ ও শিল্পায়নের তাগিদে উর্বর কৃষিজমি নষ্ট করা হয়েছে। চাষযােগ্য জমিতে গড়ে তােলা হয়েছে SEZ (Special Economic Zone)। দেশি-বিদেশি শিল্পপতি, পুঁজিপতি ও বহুজাতিক কোম্পানির রাক্ষুসে থাবায় বহু কৃষক পরিবার তাদের একমাত্র আবাদযােগ্য জমি থেকে উচ্ছেদ হয়েছে। গুজরাটে উকাই-এর বাঁধ ও সেচ প্রকল্পের ধাক্কায় ৭০ হাজার উপজাতি পরিবার বাস্তুচ্যুত হয়ে নতুন করে ছিন্নমূল উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছে।


(৯) পশ্চিমি ভােগবাদী সংস্কৃতির প্রভাব: বিশ্বায়নের ফলে ভারতের নিজস্ব সংস্কৃতি বিপন্ন হয়ে ধ্বংসের মুখে পতিত হয়েছে। পশ্চিমি ভােগবাদী সংস্কৃতি ভারতের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নষ্ট করে দিচ্ছে। ভােগবাদী সংস্কৃতির প্রচারের ফলে আঞ্চলিক ও জাতীয় সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য ক্ষুন্ন হতে চলেছে। বিশ্বায়ন মূলত প্রাচ্য সংস্কৃতি, সৃষ্টিশীলতাকে ধ্বংস করে দিতে চাইছে।


(১০) পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে: বিশ্বায়নের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মানব সমাজের পরিবেশ। পরিবেশ আজ সংকটে বিপন্ন। বিশ্বায়নের ফলে ভারতে গড়ে ওঠা শিল্পকারখানা ভয়াবহ দূষণ ছড়াচ্ছে আকাশে-বাতাসে। যা Eco Friendly নয় বা পরিবেশ বান্ধব নয়। ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে ভূপালের ভয়াবহ কার্বাইড কারখানার ক্ষত এখনও শুকোয়নি। তা ছাড়া উন্নয়নশীল দেশগুলিতে অবাধ বাণিজ্য নীতির সুযােগে উন্নত দেশগুলির উৎপাদন কেন্দ্রের বর্জ্য পদার্থ পরিত্যক্ত হওয়ার কারণেও পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।


উপসংহার: বিশ্বায়নের প্রভাব আজ সমাজের সর্বস্তরে দেখা যাচ্ছে। বাজার অর্থনীতি, উদারীকরণ, বেসরকারিকরণ, প্রযুক্তিবিদ্যার যথেষ্ট ব্যবহারের দ্বারা বিশ্বায়ন প্রক্রিয়াকে ডেকে আনা হচ্ছে। এখন প্রশ্ন হল, বিশ্বায়নের এই অশুভ প্রভাব থেকে মানব সমাজ কীভাবে মুক্তি পাবে? এই কুপ্রভাব দূর করতে হলে ভারতীয়দের সমাজ সচেতন হয়ে নিজস্ব সংস্কৃতি ও সংস্কারের কাজে আত্মনিয়ােগ করতে হবে, ঘরে-ঘরে শিক্ষার আলাে পৌছে দিতে হবে, বিদেশিদের উপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে, উন্নত বিশ্বের বিজ্ঞানের ভালাে দিকগুলি গ্রহণ করতে হবে, মন্দ দিকগুলিকে আস্তাকুঁড়ে ছুড়ে ফেলে দিতে হবে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতি এবং দেশীয় সংস্কৃতি চর্চাই পারবে বিশ্বায়নের কুপ্রভাবমুক্ত বাঁচার রাস্তা খুঁজে দিতে।