ক্ষমতা বা শক্তি বলতে কী বােঝায় | জাতীয় ক্ষমতার প্রকৃতি

ক্ষমতার সংজ্ঞা

আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ক্ষমতার ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। অভিপ্রেত ফললাভের সামর্থ্যকেই ক্ষমতা বলা হয়। হ্যান্স জে মরগেনথাউ-এর মতে, ক্ষমতা হল অন্যের মন ও কাজকর্মের উপর একজন মানুষের নিয়ন্ত্রণ। তিনি 'রাজনৈতিক ক্ষমতা' বলতে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের অধিকারীদের নিজেদের মধ্যে এবং সাধারণভাবে তাদের সঙ্গে জনগণের পারস্পরিক নিয়ন্ত্রমূলক সম্পর্ককে বােঝাতে চেয়েছেন।


অর্গানস্কির মতে, নিজ ইচ্ছা অনুযায়ী অন্যের আচরণকে নিয়ন্ত্রিত বা প্রভাবিত করার সামর্থ্যকে শক্তি বলে। জোসেফ ফ্রাঙ্কেল-এর মতে, অন্যের মন ও কার্য নিয়ন্ত্রণ করে কাঙ্ক্ষিত ফললাভের সামর্থ্যই হল ক্ষমতা।


সুতরাং বলা যায় যে, ক্ষমতা হল এক ধরনের সম্পর্ক যার মাধ্যমে কোনাে ব্যক্তি বা রাষ্ট্র ইচ্ছামতাে অন্যদেরকে কাজ করতে বাধ্য করে। তবে মনে রাখতে হবে ক্ষমতাকে অনেকসময় প্রভাবের সঙ্গে সমার্থক বলে মনে করা হয়, বাস্তবে কিন্তু ক্ষমতা ও প্রভাব এক নয়। প্রভাবের ক্ষেত্রে নিজের ইচ্ছানুযায়ী কোনাে কাজ করানাের মানসিকতাকে বােঝায়, কিন্তু শক্তির সঙ্গে ভীতি প্রদর্শনের ব্যাপার জড়িত থাকে।


অন্যদিকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী শ্লেইচার-এর মতে, কাউকে ভয় দেখিয়ে বা প্রলােভনের দ্বারা পুরস্কার প্রদানের মাধ্যমে কোনাে কাজ করানাে বা নিজের মতে আনার সামর্থ্য হল ক্ষমতা। কলম্বাস এবং উল্ফে তাদের ‘An Introduction to International Relations' নামক গ্রন্থে বলেছেন যে, অর্থনীতিতে সম্পদের যেমন গুরুত্ব, রাজনীতিতে ক্ষমতা বা শক্তির সেইরূপ গুরুত্ব। অর্থাৎ ক্ষমতা বা শক্তি হল প্রভাব ও বলপ্রয়ােগের একটি মধ্যবর্তী ধারণা।


জাতীয় ক্ষমতার প্রকৃতি


আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও রাজনীতিতে ক্ষমতা বা শক্তি হল গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় ধারণা। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির মূল আলােচ্য বিষয় হল ক্ষমতা বা শক্তি। নিজ নিজ জাতীয় স্বার্থ ও নীতি অনুযায়ী অন্য রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণকে প্রভাবিত করার ক্ষমতাকেই বলা হয় জাতীয় শক্তি বা ক্ষমতা। রাষ্ট্রের অস্তিত্ব অনেকাংশে ক্ষমতার উপর নির্ভরশীল।


আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিখ্যাত লেখক কৌলম্বিস ও উল্ফে মনে করেন যে, শান্তি, নিরাপত্তা, জাতীয় উন্নয়ন প্রভৃতি লক্ষ্য পূরণের জন্য রাষ্ট্র ক্ষমতা প্রয়ােগ করে থাকে। অপরদিকে, হ্যান্স জে মরগেনথাউ প্রমুখ বাস্তববাদী তত্ত্বের প্রবক্তা ক্ষমতাকে একইসঙ্গে লক্ষ্য এবং লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার উপায় বলে মনে করেন।


আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে দুটি অনুমানের উপর ভিত্তি করে ক্ষমতার ধারণা গড়ে উঠেছে।

  • প্রথমত, যুদ্ধ করার সামর্থ্যকে ক্ষমতা বােঝায়;
  • দ্বিতীয়ত, ক্ষমতা পরিমাপযােগ্য।

তবে অর্গানস্কি মনে করেন যে, আন্তর্জাতিক ক্ষমতার পরিমাপ করা সহজ নয়, কারণ বর্তমানে ক্ষমতার সঙ্গে বহু বােধগম্যহীন উপাদানও জড়িত থাকে।


অর্থাৎ বলা যায় যে, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সামরিক ক্ষমতার গুরুত্ব থাকলেও অর্থনৈতিক বিকাশ, প্রাকৃতিক সম্পর্ক, ভৌগােলিক অবস্থান, জনসংখ্যা, জাতীয় চরিত্র ও আত্মবিশ্বাস, কূটনীতি ইত্যাদি অসামরিক উপাদানসমূহ শক্তি বা ক্ষমতার বিশ্লেষণে অধিকতর গুরুত্ব অর্জন করেছে।


ক্ষমতার ধারণা বলপ্রয়ােগ অপেক্ষা ব্যাপক: কৌলম্বিস ও উল্ফে বলপ্রয়ােগ বলতে সামরিক শক্তির প্রয়ােগকে বােঝাতে চেয়েছেন। কিন্তু ক্ষমতার ধারণা ব্যাপক। ক্ষমতা বলতে বলপ্রয়ােগ বা বলপ্রয়োগ ভীতি প্রদর্শনকেই বােঝায় না, সেইসঙ্গে অর্থনৈতিক পুরস্কার, মতাদর্শগত ঐক্য, আলাপ-আলােচনার মাধ্যমে নিজের বক্তব্যের সপক্ষে অন্যকে নিয়ে আসাকেও বােঝায়।


সমন্বয় সাধনকারী ধারণা হল ক্ষমতা: অনিচ্ছাসত্ত্বেও কাউকে কোনাে কাজ করতে বাধ্য করার সামর্থ্যকে শক্তি বলা হয়। কিন্তু প্রভাব বলতে বলপ্রয়ােগ না করে অন্যকে দিয়ে কোনাে কাজ করানাে বা কাজ থেকে বিরত করাকে বােঝায়। অর্থাৎ ক্ষমতা ও প্রভাব সমার্থক নয়। তাই কৌলম্বিস ও উল্ফের মতে, ক্ষমতা হল বল প্রয়োগ এবং প্রভাবের মধ্যবর্তী সমন্বয়কারী ধারণা।


ক্ষমতা পরিমাপযােগ্য: অধ্যাপক হ্যান্স জে মরগ্যানথাউ মনে করেন যে, ক্ষমতা পরিমাপ যোগ্য এবং পরিসংখ্যানের মাধ্যমে প্রকাশযােগ্য। ক্ষমতা প্রয়ােগের পর ফলাফলের ভিত্তিতে ক্ষমতার পরিমাপ করা সম্ভব। কোনাে কোনাে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর অনুমান,ক্ষমতা বলতে প্রধানত সামরিক শক্তিকে বােঝায়। তবে বর্তমানে অসামরিক কারক (Actor) বা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা ও ক্ষমতা বা শক্তির নির্ধারকরূপে দায়িত্ব পালন করে।


মূল্যায়ন: ক্ষমতা বা শক্তি একটি কেন্দ্রীয় ধারণারূপে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিভিন্ন রাষ্ট্রকে ক্ষমতা বা শক্তির ভিত্তিতে অতি বৃহৎ শক্তি, বৃহৎ শক্তি, মাঝারি শক্তি, ক্ষুদ্র শক্তি ইত্যাদি রূপে স্তরবিন্যাস করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সােভিয়েত ইউনিয়ন অতিবৃহৎ শক্তিরূপে আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু সােভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের একমাত্র মহাশক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। তবে বর্তমান আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় জনমতের গুরুত্ব ও তাৎপর্য বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ক্ষমতার ধারণার পরিবর্তন ঘটেছে। অধুনা আক্রান্ত রাষ্ট্রসমূহ মানসিকভাবে হতাশ হয়ে পড়ে না; বরং সমবেত হয়ে তারা প্রবল প্রতিপক্ষ হিসেবে প্রতীয়মান হয়। রাষ্ট্র শান্তি, নিরাপত্তা ও জাতীয় উন্নয়নের লক্ষ্যে ক্ষমতাকে ব্যবহার করে।


আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিকাশে আদর্শবাদ, বাস্তববাদ, বহুত্ববাদ ও আচরণবাদের অবদান সংক্ষেপে লেখা।


আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিকাশে কাঠামােবাদ, নয়া উদারনীতিবাদ এবং নয়া বাস্তববাদের অবদান সম্পর্কে সংক্ষেপে আলােচনা করাে।


আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রকৃতি ও পরিধি বা বিষয়বস্তু বিশ্লেষণ করাে।