বিশ্বায়নের কারণ বর্ণনা করাে।

ভূমিকা: বিশ্বায়ন হল একটি ব্যাপক অর্থবহ ধারণা। এটি কোনাে একক প্রক্রিয়া নয়। এ হল বিবিধ প্রক্রিয়ার এক জটিল যৌগ। এই প্রক্রিয়া বিশ্বব্যাপী বহমান। আধুনিক সময়ে যে ধারণাটি সমগ্র বিশ্বের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে আলােড়িত করেছে, তা হল বিশ্বায়ন। বিশ্বায়নের কারণে বিশ্বের বেশিরভাগ রাষ্ট্রেই এখন উদারীকরণের ঢল নেমেছে, বিশ্বায়নের ফলে কোনাে রাষ্ট্রই নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখতে পারছে না। বিগত শতাব্দীর নব্বই-এর দশকে বিশ্ব অর্থভাণ্ডার ও বিশ্বব্যাংকের সুপারিশে উন্নয়নশীল দেশগুলি তাদের অর্থনৈতিক কাঠামাের সংস্কারসাধন করেছে। ফলে নিজের দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারকে বহির্বিশ্বের সামনে উন্মুক্ত করে দিয়েছে। রাষ্ট্রগুলির এই অর্থনৈতিক সংস্কারের পিছনে দায়ী ছিল বিশ্বায়ন ও তাদের পৃষ্ঠপােষক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলির চাপ। কিন্তু এর ফলস্বরূপ উন্নত ও উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দেশগুলি বিশ্বায়ন প্রক্রিয়াকে স্বাগত জানায়।


বিশ্বায়নের কারণ

প্রথমত: গত শতকের আটের দশকে বা তার আগে কিংবা পরে বিশ্বায়ন নতুন উদ্যমে যাত্রা শুরু করে। এর কারণ হল বিগত তিন-চার দশকে বিজ্ঞান, প্রযুক্তিবিদ্যা ও কারিগরি কলাকৌশলের ক্ষেত্রে যে অভূতপূর্ব বিপ্লব এসেছে, তার ফলে বিশ্বের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সঙ্গে অতি সহজে যােগাযােগ স্থাপিত হয়েছে। মূলধন ও প্রযুক্তিগত কলাকৌশলের আদানপ্রদান আজ বিশ্বজনীন হয়ে উঠেছে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি আজ নিজেদের বিকাশের প্রয়ােজনে শিল্পসমৃদ্ধ দেশ গুলো থেকে পুঁজি ও কারিগরি কলাকৌশল আমদানির দিকে নজর দিচ্ছে। অপরদিকে, লাভজনক বিনিয়োগের আশায় উন্নত দেশগুলি এসব রপ্তানি করতে বিশেষ আগ্রহী। উভয়ই যেখানে সহযােগিতার হাত সম্প্রসারিত করেছে সেখানে প্রয়ােজনীয় পুঁজি ও দ্রব্যসামগ্রীর অবাধ আদানপ্রদানে প্রতিবন্ধকতা থাকা একেবারেই কাম্য নয়। মূলধন এবং কলাকৌশলের অবাধ গতি বৃদ্ধি পাওয়ায় বিশ্বায়ন তার জয়যাত্রাকে গতিসম্পন্ন করে তুলেছে। উপগ্রহ যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলে টেলিফোন, ফ্যাক্স, মোবাইল ফোন, ইনটারনেট ও কম্পিউটারের ব্যবহার করা হচ্ছে। মাইক্রোচিপ ব্যবহার করে তথ্যভাণ্ডার গড়ে তােলা হচ্ছে।


দ্বিতীয়ত: বিশ্বায়নের আবির্ভাবের অন্য একটি কারণ হল সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন। সাম্যবাদের পতনের পর দ্বিমেরুতার স্থান দখল করল একমেরুতা এবং বিশ্বব্যাপী একটিমাত্র মতাদর্শ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল, সেটি হল পুঁজিবাদ বা পুঁজিবাদী দুনিয়ার মদতে গড়ে ওঠানয়া উদারনীতিবাদ। আজও যেসকল সাম্যবাদী মতাদর্শের দেশ আছে তারাও পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বহু উপাদান গ্রহণ করে নিজেদেরকে সমৃদ্ধিশালী করে তােলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিশ্ববাসী আজ উপলব্ধি করতে পেরেছে যে, পুঁজিবাদী দুনিয়ার নেতৃত্বে পরিচালিত বিশ্বায়নের প্রভাব থেকে নিজেদেরকে সরিয়ে রাখা যাবে না। এই বােধােদয় বিশ্বায়ন সৃষ্টির একটি বড় কারণ। এই বিশ্বায়নের ফলেই মূলধনের সচলতা সহজেই উৎপাদিত দ্রব্য সমূহ বিশ্ববাজারে উপস্থিত ও বিক্রয় করতে সক্ষম করে তুলেছে।


তৃতীয়ত: উপনিবেশবাদ পরবর্তী যুগে বিশ্বের সকল উন্নয়নশীল দেশের অন্যতম লক্ষ্য হল দ্রুত বিকাশের ব্যবস্থা করা। তারা বাস্তববাদী হয়ে উন্নত রাষ্ট্রগুলি থেকে বিকাশের উপাদান সংগ্রহে সচেষ্ট হয়। এই মানসিকতা থেকেই জন্ম নেয় বিশ্বায়ন। এই সন্ধিক্ষণে আর-একটি উপাদান হল, বিকাশের জন্য রাষ্ট্রের ভূমিকা অপেক্ষা ব্যক্তিমালিকানার ভূমিকা বেশি কার্যকর।


চতুর্থত: বিশ্বায়নের আবির্ভাবের আর-একটি কারণ হল রাষ্ট্রনেতা, রাজনীতিবিদ, প্রশাসক প্রভৃতিদের দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তাধারার বদল। এরা মনে করেন যে, উন্নয়নে রাষ্ট্রের ভূমিকা ক্রমাগত ক্ষীণ হয়ে আসছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলির বহুজাতিক সংস্থা এবং বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল এবং উন্নয়ন ও পুনর্গঠনের নিমিত্ত আন্তর্জাতিক ব্যাংক প্রভৃতি বিশ্বের অর্থব্যবস্থার পুনরুজ্জীবন ও পুনর্গঠনের জন্য সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। এই সংস্থাগুলি নিজেদের প্রয়ােজনে তৃতীয় বিশ্বের অর্থনীতিতে উপস্থিত হয়। অপরদিকে, তৃতীয় বিশ্বের দেশ সমূহ যাবতীয় ছুতমার্গকে বিসর্জন দিয়ে উন্নয়নের যজ্ঞে শামিল হয়। তৃতীয় বিশ্বের মানসিকতার এই পরিবর্তন বিশ্বায়নের আবির্ভাবকে ত্বরান্বিত করে। চিনের মতাে কট্টর সাম্যবাদী রাষ্ট্রও বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করে। ভারতের বামপন্থীরাও উদারীকরণ ব্যবস্থাকে স্বীকৃতি দেয়। বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া সেই সমস্ত রাষ্ট্রগুলিকে স্পর্শ করেছে, যে-সমস্ত রাষ্ট্রে প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ আছে। বর্তমানে কোন রাষ্ট্র কতখানি বিশ্বায়ন প্রক্রিয়াকে গ্রহণ করতে পেরেছে তা নির্ভর করে সেই দেশের জনগণের বিশ্বায়ন গ্রহণ করার মানসিকতার উপর। জনগণ অনেকসময় পশ্চিমি ভােগবাদী সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বিশ্বায়নকে স্বাগত জানায়।


উপসংহার: সবশেষে বলা যায় যে, বিশ্বব্যাপী মানসিকতার পরিবর্তন বিশ্বায়নের পক্ষে গিয়েছিল। শুল্ক শিথিলতার ফলে বিশ্ব বাণিজ্য সম্প্রসারিত হয়। বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যম ব্যবস্থার সম্প্রসারণ ঘটে এবং ব্যাংক ব্যবস্থাকে বিশ্বপ্রকৃতিসম্পন্ন করে গড়ে তােলে ও সহজতর আদানপ্রদান ব্যবস্থা বা ইন্টারনেটের অপরিহার্যতা বিশ্বায়নের গতির সঞ্চার করে।