বিশ্বায়নের প্রভাবে ভারতের অর্থনৈতিক সংস্কারসমূহ আলােচনা করাে।

ভারতের অর্থনৈতিক সংস্কারসমূহ

ভূমিকা: ভারতে আধুনিক বিশ্বায়নের প্রভাব প্রথম পরিলক্ষিত হয় প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর আমলে। বিশ্বায়নের আরম্ভ প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাওয়ের আমলে। ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে নরসিমহা রাওয়ের প্রধানমন্ত্রীত্বেই ভারতে তথাকথিত আর্থিক সংস্কার শুরু হয়। ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে সরকার নতুন শিল্পনীতি ঘােষণা করার ফলে বিলগ্নিকরণ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তার সঙ্গেই বিদেশি পুঁজির জন্য দরজা খুলে দেওয়া ও সরকারি সংস্থার বেসরকারিকরণ ও আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল জোর কদমে। এর পরের বছরই অর্থাৎ ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে বৈদেশিক আর্থিক সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী আর্থিক সংস্কারের ঐতিহাসিক বাজেট পেশ করা হয়। এই বাজেটে ১৯৯৮-১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে প্রায় সব রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রে সরকারি শেয়ার ২৬ শতাংশে কমিয়ে আনার ঘােষণা করা হয়। এই কারণেই ভারতে নব্বই-এর দশককে আর্থিক সংস্কারের দশক বলে অভিহিত করা হয়।


নেহরু মডেল: ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু স্বাধীনতার পর থেকেই ভারতে শুধু রাজনৈতিক জগৎ নয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক জগৎকে নিয়ন্ত্রণ করে চলতেন। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে নেহরু সরকার মিশ্র অর্থনীতির নীতি গ্রহণ করলেন। ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত পঞ্ বার্ষিকী পরিকল্পনার সূচনা, ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার ঘোষণা এইসব এককথায় নেহরু মডেল নামে পরিচিত।


নেহরুর মৃত্যুর পর ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে নেহরু-কন্যা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির আমলে একটু অন্যরকম ভাবনা শুরু হয়। তিনি নতুন শিল্পনীতি ঘােষণা করেন, কারণ তখন ভারতের আর্থিক চিত্র ছিল অত্যন্ত খারাপ। মুদ্রাস্ফীতি প্রায় রেকর্ড পরিমাণ বেড়ে যাওয়া সত্ত্বেও উৎপাদন ক্ষমতা মাত্র ৪ শতাংশ ছিল। ইন্দিরা গান্ধির পুত্র রাজীব গান্ধি নিজ উদ্যোগে কিছু সংস্কার কর্মসূচি বা উদারীকরণ শুরু করেছিলেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ধনী ব্যক্তিদের কর হ্রাস, আমদানি নীতি সহজ করা, বিদেশি লগ্নিকারকদের সুবিধা দান, বেসরকারিকরণ প্রভৃতি। রাজীব গান্ধি সামাজিক ন্যায়বিচার অর্থনৈতিক বিকাশের মতােই গুরুত্ব দিয়েছিলেন। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নরসিমহা রাওয়ের আমলে বিশ্বায়ন বা উদারীকরণ বা আর্থিক সংস্কারের প্রকৃত সূচনা ঘটে।


আর্থিক সংস্কারের সূচনা: ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দের ২৪ জুলাই ভারতে আর্থিক সংস্কারের ইতিহাসে সবচেয়ে স্মরণীয় দিন বলে চিহ্নিত। ওই দিন চার দশকের নেহরু নীতি বর্জন করে নরসিমহা রাও সরকার তার বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অর্থমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং-কে দিয়ে নতুন শিল্পনীতি ঘােষণা করলেন এবং এই নতুন শিল্পনীতিতে অবাধ বাজার অর্থনীতি, সরকারি সংস্থার বেসরকারিকরণ এবং বিদেশি পুঁজির স্বেচ্ছাচারের সূচনা ঘটল। ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে নরসিমহা রাও সরকারের আর্থিক সংস্কারের অন্যতম প্রধান একটি বিষয় ছিল কাঠামােগত সমঝােতার নীতি (Structural Adjustment Policy), যা পশ্চিমী অর্থনীতির মূল কথা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।


আর্থিক সংস্কারের মূল নীতি: নরসিমহা রাও সরকার কতকগুলি বিশেষ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন-(১) ১৮টি বিশেষ শিল্প ছাড়া শিল্প সংক্রান্ত লাইসেন্স প্রথার অবলুপ্তি, (২) মেট্রোপলিটন এবং নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা আইনের অধীন প্রয়ােজনীয় বিধিনিষেধের অবসান, (৩) বিদেশি ব্যবসায়ীদের শেয়ার কেনার সীমা বৃদ্ধি করা, (৪) রাজনীতিবিদ ও আমলাদের প্রভাব ও চাপ মুক্ত করা।


২০০৩ খ্রিস্টাব্দে বিজেপি পরিচালিত পূর্বতন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর জোট সরকার পর্যন্ত এই আর্থিক সংস্কার নীতি অনুসরণ করে। বিজেপি ও জাতীয় মাের্চা মুখে স্বদেশিয়ানার কথা বললেও রাওয়ের থেকে জোর কদমে উপরোক্ত কর্মসূচি কার্যকরী করেছে এবং নতুন নতুন নীতি গ্রহণ করেছে। তবে বর্তমান সরকারের কাছে আর্থিক সংস্কার বলতে মূলত বিলগ্নিকরণকেই বােঝানাে হয়। এর ফলে সরকারি সংস্থাগুলি দেশি-বিদেশি পুঁজিপতিদের কাছে সবকিছু বিক্রি করে দিচ্ছে। এর দরুন ভারত ভবিষ্যতে শিল্প-বাণিজ্যে স্বনির্ভর হয়ে উঠতে পারবে।


আর্থিক বিশ্বায়নের উন্মেষ: ভারতের নতুন আর্থিক সংস্কারের ফলে ভারতে আর্থিক বিশ্বায়ন ঘটে চলেছে। এ কারণে ভারত বর্তমানে নতুন বিশ্ব অর্থব্যবস্থার অন্যতম শরিক। সেই হিসেবে ভারত বিশ্ব পরিবার বা বিশ্ব গ্রামের সদস্য হিসেবে নিজেকে অন্তর্ভুক্ত করে। আর্থিক সংস্কার সূচির পরিকল্পনা অনুসারে ভারত GATT চুক্তির মতাে বিভিন্ন চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। বর্তমান মোদি সরকারের Demonetization, GST, সুদের পরিমাণ হ্রাস, ব্যাংক বিল প্রভৃতি রাষ্ট্রীয় বৈষয়িক উদারীকরণ বা সংস্কারের আরও কয়েকটি সাম্প্রতিক নিদর্শন হল মাত্র ছয়টি শিল্পক্ষেত্র ছাড়া সব শিল্পে নিয়ন্ত্রণ তুলে নেওয়া। এই ছয়টি ক্ষেত্র হল মদ, তামাক, প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি, শিল্পে ব্যবহৃত বিস্ফোরক, বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক, ওষুধ ও মদের উপকরণ প্রভৃতি।


এ ছাড়া মাত্র চারটি ক্ষেত্রকে রাষ্ট্রের মধ্যে রেখে সব উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। এগুলি হল অস্ত্র, গােলা-বারুদ, প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম, প্রতিরক্ষা বিমান, যুদ্ধজাহাজ,  পারমাণবিক শক্তি,  ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ মার্চ ভারত সরকারের বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী বিষয়গুলি এবং রেলপথ পরিবহণ।


নতুন শিল্পনীতি বা আর্থিক সংস্কারের ফলাফল: ভারত হল জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র। এই কারণে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ এবং রাষ্ট্রীয় পরিসেবা ভারতের শুধু সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতি নয়, ভারতের সমাজ ও রাজনীতির সঙ্গেও ওতপ্রােতভাবে জড়িত। বেসরকারিকরণ এই উদ্যোগ অতি উৎসাহী পদক্ষেপ গ্রহণ করে চলেছে।


ভারতে বিশ্বায়নের সুবিধা ও অসুবিধা | ভারতে বিশ্বায়নের সুফল ও কুফল


সার্বভৌমত্ব ধারণা বিশ্বায়নের প্রভাব | বিশ্বায়নের প্রভাবে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব কি সংকটের সম্মুখীন? রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতার উপর বিশ্বায়নের প্রভাব


প্রযুক্তিগত বিপ্লব এবং কাঠামােগত বিন্যাস বিশ্বায়নের এই দুটি দিক রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতাকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করেছে বলে তুমি মনে করাে?