বিশ্বায়নের প্রকৃতি আলােচনা করাে।

ভূমিকা: ‘বিশ্বায়ন’ শব্দটি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে একটি অপেক্ষাকৃত নতুন ধারণা। ইংরেজি শব্দ 'Globalization'-এর বাংলা প্রতিশব্দ হল বিশ্বায়ন বা ভুবনায়ন। বিশ্বায়নের অর্থ হল পৃথিবীর নানাদেশের মধ্যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক বাধাকে দূর করে ব্যাবসাবাণিজ্য-সহ সমস্ত ক্ষেত্রে একক বিশ্বের আদর্শ সুপ্রতিষ্ঠিত করা। অধ্যাপক রবার্টসন হলেন বিশ্বায়ন’ধারণার প্রথম প্রবর্তক। তিনিই প্রথম বিশ্বায়ন ধারণার আনুষ্ঠানিক রূপ দেন। ১৯৬০-এর দশকে বিশ্বায়ন-এর ধারণার উৎপত্তি হয় এবং ১৯৮০-র দশকে বিশ্বায়ন শব্দটি ব্যাপক প্রচারলাভ করে। এরপর ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দের পর এই ধারণার প্রয়ােগ শুরু হয়।


বিশ্বায়নের প্রকৃতি

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বিশ শতকের সত্তরের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময়কালটিকে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত ও পুঁজিবাদের স্বর্ণযুগ বলে চিহ্নিত করা যায়। কিন্তু নানা কারণে পুঁজিবাদী দেশগুলি অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে পড়লে লগ্নিপুঁজির বিশ্বব্যাপী সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যেই তার অবাধ বাণিজ্যের উপর গুরুত্ব আরােপ করে। নয়া সাম্রাজ্যবাদী লিপার শোষণমূলক চরিত্রটিকে আড়াল করার জন্য তার নতুন নাম দেওয়া হয় বিশ্বায়ন। বিশ্বায়নের প্রকৃতিকে প্রধানত নিম্নলিখিত তিনটি দিক থেকে আলােচনা করা যায়, যথা—


[1] আর্থিক দিক: বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রসার, বিভিন্ন দেশের মধ্যে অর্থ ও অন্যান্য বিনিময় মাধ্যমের সঞ্চালন, এক দেশ থেকে অন্য দেশে লগ্নিপুঁজির আদানপ্রদান, বহুজাতিক অথবা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থাগুলিকে বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও উৎপাদনের অবাধ স্বাধীনতা দান এবং বিভিন্ন দেশের মধ্যে প্রযুক্তির আদানপ্রদান এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তথ্য মাধ্যমের বিস্তার ও বিভিন্ন দেশের তথ্য মাধ্যমের উপর বৈদ্যুতিন প্রযুক্তির প্রয়ােগ প্রভৃতি। একদিকে ক্রেতার সংখ্যা ক্রমশ কমছে, অন্যদিকে মজুত মালের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে সারা বিশ্বব্যাপী দেখা দিচ্ছে আর্থিক মন্দা ও বৈষম্য। অবাধে কলকারখানা বন্ধ হওয়ায় শ্রমিক-কর্মচারী উপবৃত্ত হচ্ছে একদিকে ধনিক শ্রেণির হাতে পাহাড়প্রমাণ পুঁজি জমা হওয়ায় ধনী আরও ধনী হচ্ছে এবং অন্যদিকে কৃষক ও শ্রমজীবী শ্রেণির মানুষ হয়ে পড়ছে দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর। বলাবাহুল্য, বিশ্বব্যাপী জন্ম নিচ্ছে এক উদ্বাস্তু সমস্যা যা দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিচ্ছে।


[2] রাজনৈতিক দিক: রাজনৈতিক দিক থেকে বিশ্বায়ন জাতি-রাষ্ট্রের সম্পূর্ণ বিরােধী। সাধারণভাবে গণতান্ত্রিক প্রকৃতি সম্পন্ন প্রতিটি জাতি-রাষ্ট্র সাধারণ মানুষের স্বার্থে পুঁজির অবাধ মুনাফা ও অবাধ লুণ্ঠনের উপর নানাপ্রকার বাধানিষেধ আরােপ করে। তবে, বিশ্বায়ন বিস্ময়করভাবে স্বায়ত্তশাসনের নানাবিধ প্রতিষ্ঠানকে বাঁচিয়ে রাখতে আগ্রহী। এর কারণ হল শক্তিশালী জাতি-রাষ্ট্র বিশ্বায়ন বৃহৎ পুঁজির সঙ্গে দর কষাকষি করতে সক্ষম, অপরদিকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বায়ত্তশাসন মূলক প্রতিষ্ঠানগুলির সেই সামর্থ্য থাকে না। বৃহৎ পুঁজির নির্দেশেই তা পরিচালিত হতে বাধ্য। এইভাবে বিশ্বায়নের পাশাপাশি বিশ্বের আঞ্চলিকীকরণও ঘটেছে। এই প্রসঙ্গে জোসেফ নাই এবং জন ডি জোনাহিউ তাঁদের "Governance as a Globalization World’ গ্রন্থে লিখেছেন বিশ্বায়ন এক দেশ থেকে অন্য দেশে শ্রমিকের গমনাগমন, তথ্য প্রযুক্তির ব্যাপক উন্নতি ও সরকারের ব্যবহারযােগ্য কর (Tax) ব্যবস্থা এবং মূলধনের সচলতার সাবেকি ধারণাকে পালটে দিয়েছে। এই উদ্দেশ্যসাধনের জন্য সারা বিশ্বের বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করছে পৃথিবীর গুটিকয়েক দেশ। তাদের রথের ঘােড়া 201-IMF, WTO, World Bank, NATO, EEC এবং বহু মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি প্রভৃতি।


[3] সাংস্কৃতিক দিক: বিশ্বায়নের লক্ষ্য হল বিশ্বব্যাপী একটি সমরূপ সংস্কৃতি গড়ে তােলা। ইনটারনেট-সহ বিভিন্ন অত্যাধুনিক গণমাধ্যমের সাহায্যে এরূপ সংস্কৃতি গড়ে তােলার কাজে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম কর্পোরেশনগুলি আত্মনিয়ােগ করে। তারা জাতি-রাষ্ট্রের গণ্ডি ছাড়িয়ে সাংস্কৃতিক প্রবাহকে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। অর্থাৎ সাংস্কৃতিক দিক থেকে বিশ্বায়ন সারাবিশ্বে Tele Electronic, Homogeneous Culture গড়ে তুলতে চায়। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পৃথিবীর একটি অংশের উৎপাদিত উদ্বৃত্ত পণ্য সামগ্রী, তথ্য প্রযুক্তি, ধ্যানধারণা, অন্য রাষ্ট্রের দ্বারা চালিত হচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশগুলি ঋণের ফাঁদে জড়িয়ে যাচ্ছে। এর ফলে মানুষে মানুষে যে সাংস্কৃতিক পার্থক্য বা ভেদাভেদ আছে তা মুছে যাচ্ছে এ কাজে সাহায্য করছে উন্নত প্রযুক্তির দান ইনটারনেট, উপগ্রহভিত্তিক টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা। বিশ্বায়নের সাংস্কৃতিক দিকের ফলে আজ দুনিয়ার খবরাখবর এক মুহূর্তে সারা পৃথিবীতে ভাইরাল হয়ে যাচ্ছে।


উপসংহার: ১৯৯০-এর দশক থেকেই প্রথম ইরাক যুদ্ধ, সােভিয়েত রাশিয়ার পতন, CTBT, GATT, WTO-র সক্রিয়তা মার্কিন সেনা কর্তৃক আফগানিস্তান ও ইরাকের উপর আক্রমণ, চিনের নীরবতা, উগ্রপন্থী কার্যকলাপ বৃদ্ধি সংক্রান্ত বিভিন্ন কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সপক্ষে বর্তমানে যে বিশ্বায়নের সূর্য উদিত হয়েছে তার প্রভাব সুদূরপ্রসারী। মার্কিন শক্তি নতুন উদ্যমে বিশ্বকে শাসন করার অভিপ্রায়ে আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনগুলিকে মুক্ত বাজারের মুখােশে সুকৌশলে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে। একবিংশ শতাব্দীতে বিশ্বায়ন এক অপরিহার্য আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়া। বাজার, অর্থনীতি, উদারীকরণ ও বাণিজ্যিক বিশ্বায়ন থেকে কোনাে দেশ বাইরে বেরিয়ে আসতে পারছে না। এই পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, উন্নত দেশগুলির মােকাবিলায় উন্নয়নশীল দেশসমূহকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় বিশ্বায়নকে কাজে লাগানাে দরকার।